ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নিস্তব্ধ পাথরাইলের তাঁতপল্লী

শাহরিয়ার সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৩ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিস্তব্ধ পাথরাইলের তাঁতপল্লী

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের পাথরাইলের তাঁতপল্লী। সারা বছর যেখানে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাঁত বোনা। মাকু আর শানার খট খট শব্দে মুখরিত হয় তাঁতপল্লীর চারদিক। কিন্তু সেই তাঁত পল্লীতে এখন শুনশান নিরবতা। নেই তাঁতীদের কোলাহল। নেই মাকু আর শানার ঘর্ষণের সেই চিরচেনা শব্দ।

তাঁতপল্লীর বিপণীবিতানগুলোতে ঝুলছে তালা। আর এই সবের মূল কারণ করোনাভাইরাস।

আর দুদিন পরই বাঙালির রঙিন উৎসব পয়লা বৈশাখ। মাস খানেক পর মুসলামদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। প্রতিবছর এই সময়টুকুতে তাঁতপল্লীর তাঁতীদের দম ফেলার ফুসরত না থাকলেও, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রায় মাসখানেক ধরে করোনাভাইরাসের প্রভাবে তারা এখন বেকার।

সূত্র মতে, টাঙ্গাইল জেলায় মোট চার হাজার ১৫১ জন তাঁত মালিক রয়েছেন। আর এই সকল তাঁত মালিকের ছোট বড় ৩৪ হাজার ৪০২টি তাঁতে মোট এক লাখ তিন হাজার ২০৬ জন তাঁত শ্রমিক রয়েছেন। এই সকল তাঁতীদের বেশিরভাগই কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, মমিননগর, কোকডহড়া, দত্তগ্রাম, বেহেলা বাড়ী, ঘোণাবাড়ী, ছাতিহাটি, তেজপুর, কাজীবাড়ী, দেলদুয়ার উপজেলার চণ্ডি, পাথরাইল, পুটিয়াজানী, রূপসী, সদর উপজেলার চরকাকুয়া, চরপৌলী, হুগড়া এলাকায় বাস করেন। কালীহাতী উপজেলার বেশির ভাগ তাঁতগুলো পাওয়ার লুম হলেও, দেলদুয়ার আর সদর উপজেলার তাঁতগুলো হ্যান্ডলুম বা হাতে চালিত।

এই সকল তাঁতীদের কেউ হয়তো তাঁতে কাপড় বুনেন, কেউ কাপড় বুননের সুতা (নলি বা ছিটা) প্রস্তুত করেন, কেউ কাপড়ের নকশার সুতা কাটেন। এছাড়া, সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার জন্যও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। শ্রমিকছাড়াও অধিকাংশ ক্ষুদ্র তাঁত মালিক নিজেরাও প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রম দিয়ে থাকেন। পরিবারের সদস্যরা কাজ করেন।
 

 
বেশির ভাগ তাঁতেই শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে মজুরি দেওয়া হয়। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় তাঁত কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সব তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। সাপ্তাহিক কাপড় বোনার ওপর ভিত্তি করে তাঁতীদের মজুরি দেওয়া হয়। কিন্তু গত এক মাস ধরে তাদের উপার্জন নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

টাঙ্গাইলের পাথরাইলের চন্দ্রী এলাকার তাঁতপল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তাঁত ঘরগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।  

পাথরাইলের নলুয়া উত্তরপাড়া গ্রামের তাঁত শিল্পী আবুল হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘তাঁত বন্ধ, এ যেন আমাদের বাঁচিয়ে রেখে মুখের খাবার কেড়ে নেওয়ার মতো। আমরা তাঁত বোনা ছাড়া আর কোনো কাজ পারি না। গত এক মাস ধরে তাঁত বন্ধ করে বাড়িতে বসে আছি। কাপড় বুনতে না পাড়ায় কোনো টাকা উপার্জন হচ্ছে না। কিন্তু খাওয়া তো আর বন্ধ নেই। তাঁত চালাতে এনজিও থেকে কিস্তিতে টাকা লোন করেছি। এখন যদিও কিস্তি বন্ধ। কিন্তু করোনা চলে গেলেই কিস্তি দিতে হবে। এতো টাকা পাবো কোথায়? তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু চাল-ডালের সাহায্য পেয়েছিলাম। কিন্তু ওইটুকু দিয়ে তো আর সংসার চলে না।’

পাথরাইলের চণ্ডি এলাকার তাঁতী অসিত বসাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিপদে আছি আমরা নিন্ম মধ্যবিত্ত তাঁতীরা। আমাদের উপার্জন বন্ধ। আর লজ্জায় কারোর কাছ থেকে কোনো সাহায্যও নিতে পারি না। আমাদের মধ্যে একদম অসহায়রা কোনো রকম সাহায্য পেয়েছে। যদিও সেটা খুব সামান্য। আর ব্যবসায়ীরাও এখন আমাদের মতোই। তারা শাড়ি বিক্রি করতে পারছেন না। তাদের অনেক বড় বড় ব্যাংক লোন। আর আমরা তো শাড়ি বুনতে না পাড়ায় কোনো মজুরি পাচ্ছি না। অথচ পয়লা বৈশাখ আর ঈদের এই সময় আমরা বাড়তি পরিশ্রম করতাম। বাড়তি টাকা আয় করতে পারতাম। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরিবার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।’
 


পাথরাইলের বিষ্ণপুর এলাকার তাঁতী আজাহার মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এমন অবস্থায় আমরা আগে কখনো পড়িনি। আমাদের কোনো সঞ্চয় নেই, এনজিও থেকে লোন আছে। উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা চরম ঝুঁকিতে পড়েছি। কীভাবে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাব জানি না। পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’

একই অবস্থা তাঁত পল্লীর বিপণীবিতানগুলোতে। সেখানে নেই ক্রেতাদের আনাগোনা। শো-রুমগুলোর প্রধান ফটকে ঝুলছে তালা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পয়লা বৈশাখ আর ঈদকে সামনে রেখে এসময়ে থাকে বেঁচা-বিক্রির ধুম।কিন্তু এবার তার কিছুই হচ্ছে না।

টাঙ্গাইলের পাথরাইলের তাঁত শাড়ি ব্যবসায়ী যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির মালিক রঘুনাথ বসাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘আমাদের টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় শাড়ি তৈরির ১০ হাজার হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। আর এই সকল তাঁতে গড়ে দেড়জন করে ধরলে প্রায় ১৫ হাজার তাঁতী রয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে  তাঁতীরা পুরোপুরি বেকার রয়েছেন। অথচ পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে আমরা বাংলা বছরের পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন এই তিন মাসে প্রায় ১৯ লাখ ২০ হাজার টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিলাম।

‘প্রতিটি শাড়ি উৎপাদন খরচ গড়ে ৫৫৫ টাকার বেশি ধরলে এই পরিমাণ শাড়ি বানাতে আমাদের খরচ হতো ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।  আর সেই শাড়িগুলো গড়ে ৬০০ টাকা করে বিক্রি ধরলেও মোট ১১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা ছিল। আর তাতে শতকরা ৭ শাতংশ হারে তাঁতী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের পর্যন্ত মোট লাভ থাকতো ৮ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো। এই ৮ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা লাভের জন্য আমরা ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম।

‘এই টাকা এসেছিলো আমাদের সারা বছরের সম্বল আর ব্যাংক লোন থেকে। কিন্তু গত এক মাস ধরে করোনাভাইরাসের জন্য আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ। আর তাতে আমাদের বিপুল পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। এখন আমাদের ঘরে শাড়ি আছে, কিন্তু খাবার নেই। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আমাদের দেওলিয়া হয়ে পথে বসতে হবে।’’

ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আর এই শিল্পের কারিগড় তাঁতী আর তাদের সহযোদ্ধা পাইকাড়ি শাড়ি ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে, এমনটাই প্রত্যাশা এ শিল্প সংশ্লিষ্টদের।


টাঙ্গাইল/সিফাত/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়