ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নিজ জমিতেই মার খাচ্ছেন হাওরের কৃষক

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১১ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিজ জমিতেই মার খাচ্ছেন হাওরের কৃষক

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : ইজারাদারদের চোখ রাঙানিতে তটস্থ কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চলের কৃষক ও জেলেরা। হাওরের জলমহালগুলোর ইজারাদারদের দাপটে তারা ভীষণ অসহায় ।

শীত মৌসুম সমাগত। কমতে শুরু করেছে হাওরের পানি। ধীরে ধীরে হাওরের বুকে ভেসে উঠছে চরগুলো। বীজতলা তৈরির আগে মাছ ধরার পালা। কিন্তু মাছ ধরা তো দূরের কথা, ইজারাদাররা কঠোর আচরণ করছে কৃষক ও জেলেদের প্রতি। জাল নিয়ে নিজ জমিতে যেতেও পারছে না তারা। সেখান থেকে খাওয়ার জন্য দুটো মাছ ধরে আনবে, সে উপায়ও নেই। চারদিকে ইজারাদারদের চোখ রাঙানি আর ভয়ভীতি।

চলতি বছর অকাল বন্যায় প্রায় ৮০ ভাগ জমি তলিয়ে গিয়ে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের। তাই হাওর পাড়ের জেলে ও কৃষকরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে প্রশাসনের নিকট হাওরের জলাশয়গুলোকে উন্মুক্ত করার দাবিও জানিয়েছিল।

অন্যদিকে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ইজারাকৃত জমির চেয়ে অতিরিক্ত জমি দখল করে রাখার । ফলে নিজ জমিতে মাছ ধরতে গিয়েও হয়রানির শিকার হচ্ছেন হাওরাঞ্চলের জেলে ও কৃষক।

এপ্রিলের মাঝামাঝি হাওর অধ্যুষিত এই জেলার নিকলী, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ ৯টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষকের বোরো ধানের জমি অকাল বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে হাওরের জলাশয় থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু জলাশয়গুলোতে মাছ ধরতে গিয়ে জীবন-মরণ সংকটে পড়েছে এসব কৃষক ও জেলে পরিবার।

কথা হয় হাওরের কিছু কৃষক ও জেলের সাথে। মইচ উদ্দিন, ফেরদৌস আহম্মেদ ও মো. তাফসির নিকলী উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তারা জানান, তাদের বাড়ির পাশে চাকিডর নলুয়া চকচকিয়া নামে একটি বিল রয়েছে। ৬ বছরের জন্য সরকারিভাবে সেখানে জমি ইজারা দেওয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমাণে। কিন্তু এসব ইজারাদাররা গায়ের জোরে জিম্মি করে রেখেছে তাদের জমিও। যখনি প্রতিবাদ বা নিজ জমিতে মাছ ধরতে যান তখনই মারপিট করতে আসে তারা।

তারা আরো জানান, ইজারাদাররা ইজারাকৃত জমির বাইরেও জেলে ও কৃষকের হাজার হাজার একর জমি ভোগ করছে । কৃষকের জমির ওপর যে মাছ ঘুরে বেড়ায়, এই ভাসান পানিতেও মাছ ধরতে পারছে না কৃষক। বছরের পর বছর প্রতিবাদ করেও মিলছেনা কোন সুরাহা। বরং ইজারাদারদের অস্ত্রের আঘাতে শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাদের। কিছুদিন আগে এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৬ গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ হয়। আহত হয় আরো অনেকে।

ভুক্তভোগী কৃষক মিজানুর রহমান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের প্রায় ১৫ একর জমি ইজারাদাররা দখল করে রেখেছে। প্রতিবাদ করেছিলেন আমার ভাই। এখন তিনি অর্তকিত হামলার শিকার হয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। আমরা ভুক্তভোগী কৃষক ও জেলেরা প্রশাসনের নিকট এসব সমস্যার দ্রুত সমাধানের দাবি করছি।’

অন্যদিকে স্থানীয় ইজারাদার মতিউর রহমানের দাবি, সরকারিভাবে যতটুকু জমি তাদের ইজারা দেয়া হয় তাতে তারা মাছ চাষ করেন। ইজারা বাবদ তারা সরকারি কোষাগারে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টাকা জমা দিয়ে থাকেন। কিন্তু হাওরের পানি বেড়ে গেলে সেই মাছ আশপাশের শতশত একর জমিতে ছড়িয়ে পরে। তখন ওই মাছ অন্যদের ধরতে দিলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে তাদের। একারণেই তারা জমির মালিকদের মাছ ধরতে বাধা প্রদান করেন।

জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার সূত্র মতে, ছোটবড় মিলিয়ে জেলায় জলমহাল রয়েছে ১৯০টি। তবে এর মধ্যে নদীও রয়েছে বেশকিছু এবং সবই ইজারা দেওয়া। কৃষক বা জেলেদের জন্য রাখা হয়নি কিছুই।

জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘হাওরের প্রত্যেকটি জলমহালের একটি সুনির্দিষ্ট তফসিল আছে। যখন পানি বেড়ে যায় তখন ওই সীমানাগুলো চিহ্নিত করা যায়না। তাই যারা এই জলমহাল ইজারা নেয় তাদের সীমানার বাইরে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। তবে তফসিলকৃত ইজারা নেওয়া জায়গার বাইরে অন্য কৃষকের জমির মধ্যে কেউ যাতে মাছ ধরতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা সজাগ ও সর্তক আছি। ইজারাদাররা যেন কোনভাবেই কৃষকের জমিতে সীমানা অতিক্রম করে মাছ ধরতে না পারে সে ব্যাপারেও স্থানীয় প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ।’

জেলার হাওর অঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় হাজার হাজার জেলে ও কৃষক এই মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় নিজ জমি থেকে মাছ ধরে থাকে। কিন্তু ইজারাদারদের দৌরাত্ম্যে এসব জেলে ও কৃষকদের না খেয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দ্রুত এর সুষ্ঠু সমাধান ও নিজ জমি থেকে মাছ ধরার অধিকারের দাবি জানিয়েছেন।

 

 

রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/১১ নভেম্বর ২০১৭/রুমন চক্রবর্তী/টিপু/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়