ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘নৌকাই হয়ে ওঠে আমাদের ক্যাম্প’

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘নৌকাই হয়ে ওঠে আমাদের ক্যাম্প’

সাইফুল ইসলাম: তারুণ্যের ধর্ম পুরনো ব্যবস্থা ভেঙে নতুন কিছু করা। ১৯৭১ সালে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে নতুন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার লড়াইয়ে নেমেছিল এদেশের দামাল ছেলেরা। সে লড়াইয়ের নাম মুক্তিযুদ্ধ। লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের রিয়াজউদ্দিন শেখের ছেলে ইসমাইল হোসেন। বর্তমানে তার বয়স ৬৫ বছর। তিনি তখন সিরাজগঞ্জ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

স্কুল জীবনেই ইসমাইল যুক্ত হন ছাত্রলীগে। তখন থেকেই বিভিন্ন মিছিল, কর্মীসভায় যাতায়াত। ১৯৭০ সালে কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোদমে ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে পড়েন তিনি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় কলেজ মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ছুটে যান বাঘাবাড়িতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে। কিন্তু ভারি অস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে পিছিয়ে আসতে হয়। সেখানেও টিকতে না পেরে নেতারা বলেন, এখন যার যার মতো নিজ দায়িত্বে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। পরে আবার সংগঠিত হবো আমরা। নেতাদের কথানুযায়ী নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন ইসমাইল। বাড়ি দেখভালের জন্য তখন রয়ে গেছেন তার বাবা। পরিবারের অন্যদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য গ্রামে। ততক্ষণে শহরে এসে গেছে পাকিস্তানি মিলিটারি।

বাড়িতে মন টেকে না ইসমাইলের। এক বন্ধুকে নিয়ে বের হন কোথায় কী ঘটছে দেখার জন্য। দুজন বিভিন্ন স্থানের পোড়া বাড়িঘর দেখতে দেখতে চলে আসেন মাহমুদপুর। সেখানে পড়ে যান পাক মিলিটারিদের সামনে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে।এক পর্যায়ে কষে থাপ্পড় মেরে তাড়িয়ে দেয় দুজনকে। মার খেয়ে ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। এ সময় খবর পান, সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র-সংসদের ভিপি সোহরাব আলী সরকার তার মামাবাড়ি ভদ্রঘাটে অবস্থান করছেন। সেখানে রয়েছে ছাত্রলীগের আরো কয়েকজন নেতা। ইসমাইল বন্ধুকে নিয়ে ছুটে যান। খুঁজে বের করেন ছাত্র নেতাদের। তাদের বলেন, একটা কিছু করার জন্য। ছাত্রনেতারা ওদের কয়েক দিন পরে যোগাযোগ করার জন্য বলে বিদায় করেন। এভাবেই ঘোরাফেরা করতে করতেই এক সময় গঠন করা হয় পলাশডাঙ্গা যুব শিবির। ইসমাইলরা যুক্ত হয়ে পড়েন সেখানে। শুরু হয় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই।

কখনো আক্রান্ত হয়ে শত্রু ব্যূহ ভেঙে বেড়িয়ে আসেন লড়তে লড়তে। কখনো আক্রমণ করে তছনছ করে দেন শত্রুদের। এভাবেই চলছিল। তখন বর্ষাকাল। ভদ্রঘাটে শত্রু ব্যূহ ভেঙে বেড়িয়ে এসে তারা কয়েকটি নৌকা জোগাড় করেন। নৌকাই হয়ে ওঠে ক্যাম্প। প্রথমে পাঁচটি, তারপর দশটি- এভাবে নৌকা বাড়তে বাড়তে ছোটবড় মিলিয়ে পলাশডাঙ্গার নৌকা হয়ে ওঠে অনেকগুলো। কখনোই সে নৌকার বহর একই গ্রামে একদিন, একরাতের বেশী থাকেনি। ইসমাইলেরা যে গ্রামেই গেছেন, সে গ্রামের মানুষ তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেদিনের জনগণের ভালোবাসার কথা আজো ভুলতে পারেন না ইসমাইল।

১১ নভেম্বর সন্ধ্যার পর পলাশডাঙ্গা অবস্থান নেয় রাজা ভানুসিংহ ও জিন্দানী পীরের স্মৃতি বিজড়িত হান্ডিয়াল-নওগাঁয়। পরের দিন ভোররাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি কোম্পানি এবং ততোধিক রাজাকার সদস্যরা ঘিরে ফেলে তাদের। পলাশডাঙ্গার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শুরু হয় ভীষণ যুদ্ধ। সে যুদ্ধ চলে ১২ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত। প্রকৃতি ও জনগণের সহায়তায় বিজয়ী হয় মুক্তিযোদ্ধারা। হত্যা করা সম্ভব হয় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য ও বিপুলসংখ্যক রাজাকারকে। আটক হয় একজন ক্যাপ্টেনসহ অন্তত ১২ জন পাকিস্তানি। পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় অন্যরা। বিকেলে পলাশডাঙ্গার পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা নির্দেশ দেন ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য। তাদের সঙ্গে দেওয়া হয় ধরা পড়া এক পাকিস্তানি সৈন্যকে। তারা শীতলাই জমিদার বাড়িতে ওই পাকিস্তানিকে হত্যা করে ভারমুক্ত হয়। এরপর উধুনিয়া গ্রামে এসে বাসেদের গ্রুপ আলাদা হয়ে তাদের এলাকায় যায় এবং আওয়ালের নেতৃত্বে আরেক গ্রুপ চলে আসে শাহজাদপুরের শ্রীফলতলা গ্রামে। সেখানে পাওয়া যায় আব্দুল খালেক ও বাকী মির্জার নেতৃত্বাধীন পলাশডাঙ্গার আরেক দল মুক্তিযোদ্ধাকে।

ডিসেম্বরের প্রথম। তখন পাক-মিলিটারি অবস্থান করছিল শাহজাদপুর কলেজে। থানায় অবস্থান ছিল রাজাকার ও পাকিস্তানি পুলিশের। পলাশডাঙ্গার বিচ্ছিন্ন গ্রুপ আর ফখরুল গ্রুপ যৌথভাবে থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করে। এদিন বিপুলসংখ্যক রাজাকার আর পাকিস্তানি পুলিশকে আটক করে নিয়ে আসা হয়। পরে লুণ্ঠিত অস্ত্র দুই গ্রুপ ভাগ করে নেয়। বিজয়ের দিনক্ষণ এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারি অস্ত্রের ভাগাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হালকা অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করাটা ছিল অসম্ভব। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠছিল। ১৬ ডিসেম্বর সকালে পাক বাহিনী শাহজাদপুর কলেজের ক্যাম্প গুটিয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে পালানোর উদ্যোগ নেয়। তাদের পিছু নেয় মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। কিন্তু তাদের ভারি অস্ত্রের কাছে ভেড়া ছিল অসম্ভব। সারাদিন মুক্তিযোদ্ধা-জনতা তাদের পিছে লেগে থাকার চেষ্টা করে। সন্ধ্যায় ইসমাইলরা ফিরে আসে শাহজাদপুরের পাশের গ্রামে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে। তখন সবাই ক্লান্ত। সন্ধ্যার পর হঠাৎ শুরু হয় মূহুর্মূহু গুলি। গুলির কারণ ও উৎস খুঁজতে পাঠানো হয় এক মুক্তিযোদ্ধাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে এসে খবর দেয়- ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে।

এ খবর পেয়ে শাহজাদপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে গুলি ছুড়ছে। তখন খালেক গ্রুপে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারাও মুহুর্মূহু গুলি ছুড়ে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে। ১৭ ডিসেম্বর সকালে ফখরুলরা শাহজাদপুর কলেজে এবং খালেক-বাকীর নেতৃত্বাধীন ইসমাইলরা থানায় উত্তোলন করে স্বাধীনতার পতাকা। এ ভাবেই শাহজাদপুর মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপরেই ইসমাইলরা চার মুক্তিযোদ্ধা পায়ে হেঁটে তাদের নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জ ফিরে আসে। সিরাজগঞ্জ কলেজে খুঁজে পায় পলাশডাঙ্গার মূল বাহিনীকে। ইসমাইল জানান, বিজয়ের আনন্দ, সহযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া এবং জনগণের সে ভালোবাসা কখনোই ভোলা সম্ভব নয়।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়