ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পহেলা বৈশাখ : বাঙালি কোথায় যাচ্ছে? || টোকন ঠাকুর

টোকন ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫০, ১২ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পহেলা বৈশাখ : বাঙালি কোথায় যাচ্ছে? || টোকন ঠাকুর

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

বাঙালির বৈশাখ! বাংলা বছরের প্রথম মাস। সেই অর্থে পহেলা বৈশাখই হচ্ছে বাঙালির নববর্ষের প্রথম দিন। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন ক্রমশ বিস্তৃতি পাচ্ছে নাগরিক বাঙালির কাছে। আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে উৎসবের ধরন, উৎসবের অংশগ্রহণ। এ কথা সত্য, এখন বাঙালির বৈশাখি মেলা হয় কর্পোরেট কোম্পানির অর্থ-সৌজন্যে। আয়োজনের একটা হুল্লোড় তো বেড়েছে বটেই। সেকালে হাট বাজারের দোকানে দোকানে বিগত বছরের বাকি আদায়ের অভিলক্ষে হালখাতা করা হতো, জিলেপি-বাতাসাসহ মিষ্টিমুখ করানো হতো। গ্রামের মেলায় কুমোরেরা মাটির হাঁড়ি-কুড়ি বানিয়ে আনত। পাতার বাঁশি বাজত। খেঁজুরগাছের সাপ পাওয়া যেত। মাটির হাঁড়িতে কত কী রং করা থাকত। নাগরদোলাও ছিল। মানুষের  মধ্যে এক অকৃত্রিম ভালোবাসার উপস্থিতি চোখে পড়তই।

গ্রামভিত্তিক বাঙালি সমাজে আমরা ছোটবেলায় যেতাম বাজুখালির মেলায়। বাজুখালি ছিল ফুলহরির পাশে, ফুলহরি ছিল শৈলকুপা-হরিণাকুণ্ডু থানার মাঝামাঝি একটা নদীতীরবর্তী গ্রাম। মূলত কুমোরপাড়া অধ্যূষিত গ্রাম। শারদীয় বিসর্জনের বাইরেও সেই গ্রামে প্রতিবছর বৈশাখি মেলা হতো।

প্রায় পুরোটাই সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের গ্রাম বাজুখালি ছিল কুমার নদের পাড়ে, সেকালের বিদ্যুৎবিহীন এক গ্রাম-জনপদ। কাছাকাছিই, গাড়াগঞ্জ বাজারের পাশে মধুপুর গ্রামে আমি বড় হচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু বাইসাইকেলে ঘুরে বেড়াতাম দুধসর, চাঁদপুর, ডাঙিপাড়া, চণ্ডিপুর, কাশিমপুর, ইব্রাহিমপুর, বারোইপাড়া বা গাঙের ওপারে ছিল কৃষ্ণনগর, দহকোলা, হড়রা, রানীনগর, বড়দহ, মির্জাপুর, চড়িয়ার বিল, রাজনগর- কত কত গ্রাম। সেই গ্রাম-শৈশবের বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নেমেছি। অনেক পরে একদিন দেখি, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র। ছবি আঁকায় মনোযোগ কম কিন্তু কবিতা লেখার ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াই মহানগরীর মেট্টো-এভিনিউ জুড়ে।

তো আজকের চারুকলা ইনস্টিটিউটই হচ্ছে ঢাকায় বড় পরিসরে, রাস্তায় র‌্যালি করে বৈশাখ উদযাপনের সূতিকাগার। গত শতাব্দির `৮৬/৮৭ সালের দিকে, চারুকলার ছাত্রদের উদ্যোগে এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষকদের বাদানুবাদ শেষে তরুণ ছাত্রদেরই জয় হলো। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুরু হলো পহেলা বৈশাখের ভোরে। পরের বছর থেকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম হলো ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নানান মুখোশ, রং বেরঙের ফেস্টুন কারুকৃৎ নন্দনে তৈরি করে এই ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ র‌্যালি আজ ঢাকা শহরের এক অনবদ্য বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে। চারুকলার বাইরেও, অন্যান্য সংস্কৃতিকর্মীদের জন্যে কিংবা আজকের ঢাকা নগরবাসী এই পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে একদম নিজেদের আপন উৎসব করে নিয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপন ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অন্যান্য বর্ষবরণ উৎসবে নিজের বৈচিত্র তুলে ধরতে পেরেছে। সাড়ে ছয়শো কোটি মানব সন্তানের মধ্যে এখন প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের ভাষাই বাংলা। জনসংখ্যার হারে সম্ভবত অষ্টম পর্যায়ে রয়েছে।

বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা, বোশেখের চিত্রমালা, সঙ্গীতায়োজন, পানাহার-পহেলা বৈশাখ জমে উঠছে। কিন্তু বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়ার প্রচলনের বয়স দুই দশকের বেশি হবে না। বাঙালির বৈশাখি উৎসবে পান্তা ইলিশ একটা নাগরিক সংযোজন। যা সম্পূর্ণই একটা মূর্খ সম্প্রদায়ের ভাঁড়ামো সংযোজনমাত্র। এই মূর্খ সম্প্রদায়ই মূলত দেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো চালায়। সৃষ্টিশীলতার কোনো মুরোদ নেই, এদিক-ওদিক ঘটে যাওয়া সংস্কৃতির নানান ক্যানভাসে তারা টুকলিফাই ওয়াশ বুলোয়। এর মধ্য দিয়ে তাদের বিজ্ঞাপন বাজারটা প্রতিষ্ঠা পায়। তখন তারা মুনাফা খোটে। নদীপাড়ের ভাটিয়ালির বাঙালিকে কর্পোরেট কোম্পানি ধীরে ধীরে কনজুমার বানিয়ে ফেলে। চরিত্রহীনতা বলতে যা বুঝায়, তার সবই অর্জন করে নিজের দাহ্যশক্তি বাড়িয়ে চলেছে কোম্পানিগুলো। তাদের স্পন্সরেই  চলে আজ নানান উৎসব, নানান পার্বণ।

মুনাফা কোম্পানির, বিনোদন বাঙালির, বিশেষ করে নিপীড়িত নাগরিকদের। অবশ্য নাগরিক বলতে যা অর্থ করে, এই বাঙালি সেটা কখনো খেয়াল করে ভাবেইনি। ভাবা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষ মাঝিমাল্লারা একসময় নৌকা বাইতে বাইতে মনের সুখে কিংবা দুঃখেই গান ধরেছে- নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে...

ফলে, যতই লক্ষ লক্ষ মানুষ পহেলা বৈশাখে সেজেগুঁজে রাস্তায় বের হোক না কেন, ভেবে দেখেছি, এর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক গন্তব্য নেই। স্পন্সর কোম্পানিগুলো যে রকম চায়, বৈশাখ এখন সেরকম হয়। বৈশাখ এখন আর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোভাবকে আরো শাণিত করে সামনে দিকে নিয়ে যায় না, বৈশাখ নারী নির্যাতনের দিন হিসেবে আবিষ্কৃত হয়। বৈশাখি উৎসবের ভিড়ে নারীরা লাঞ্ছিত হয়। হচ্ছে, প্রতিবছরই। এবং তারাই এই লাঞ্ছনাকারী, মর্ষকামী-ধর্ষকামী পুরুষ, যারা থাকে সব বিচারের উর্ধ্বে, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ের ধারে-কাছে। শেষমেষ অনেক আশার নববর্ষ হয়ে ওঠে কলঙ্কের প্রতিচ্ছবি। তবু কোম্পানিগুলো তাদের কনজুমার টার্গেটে পৌঁছুতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাঙালিও উৎসব মুখর হয়ে উঠছে। আমি জানি, ‘তবু তো কিছু হচ্ছে’ বলেও খুশি হওয়ার লোক আছে। ব্যাপারটা তো এরকমই যে, ‘ব্রিটিশ ছিল বলেই ভারতীয়া রেললাইন পেয়েছে’। তার মানে ব্রিটিশ তার শাসন-শোষনের প্রয়োজনেই যে রেললাইন তৈরি করল, তাতেও আমরা বিগলিত থাকলাম। যাক, রেললাইন তো হলো। রেলে চড়তে কত সুখ!

আর গ্রাম-বাংলার হাড় জিরজিরে কৃষক, পুষ্টির অভাবে জীবনযন্ত্রায় বুক শুকিয়ে যাওয়া কৃষাণী, কামার-কুমোর-শ্রমিক-ঘরবাড়ি-জায়গাজমিহীন মানুষ আসলে টেরও পায় না, কবে চৈত্র সংক্রান্তি! কবে পহেলা বৈশাখ! আর কবে গেল ঋতুরাজ বসন্তের যৌবন-প্ররোচিত আবাহনী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই হচ্ছে গ্রামবাসিন্দা, হাড় জিরজিরে, রোগাক্লিষ্ট, অভাবী, জীবনের বেশিরভাগ চাহিদা ও স্বপ্নপূরণ না হওয়া মানুষ। ফলে তাদের কাছে কোনোভাবেই আর পৌঁছুয় না মেগাসিটির আর্বানিটি।

আমি নিশ্চিত জানি, বাংলা কবিতা বা চিত্রকলা যে একটি চর্চার বিষয়, উৎকর্ষের বিষয়, এটা দেশের খেটে খাওয়া আশি ভাগ মানুষই জানে না। মানুষ হিসেবে তাদের জীবনের কোনো স্বাভাবিক দাবিই তো এখনো পূরণ করেনি রাষ্ট্র। এর মধ্যে আমরা ‘জলতরঙ্গ দল নাচবে প্রাণে’ বলে গান গাব কখন? আমরা রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়ব কখন?

তনু, মেয়েটি এই বৈশাখে শাড়ি পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেরুবে না। তনু নেই। জান্নাত মেয়েটি বেরুবে না, সে বেঁচে নেই। প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ মরে যাচ্ছে, হত্যা হচ্ছে, ধর্ষিত হয়ে জীবন দিচ্ছে সমাজের শক্তিশালি লোকের থাবায়। কোনো বিচার হচ্ছে না। এদেশে সাধারণ মানুষ আর কোনো স্বাভাবিক বিচার কখনো পাবে কিনা, কেউ বলতে পারে না। প্রতিদিন সংখ্যালঘু উৎপীড়ন-নির্যাতন-উচ্ছেদ চলছেই।  মানুষ জানে না, মানুষ কোথায় যাচ্ছে? মানুষ বলতে আমাদের বাঙালির অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান অংশকেই আমি বোঝাচ্ছি। এবং যাদের অর্থের মূল উৎস নিঃসন্দেহে সাধারণ গরিবের টাকা লুট বা কনজুমারের ছুঁতোয় হাতিয়ে নেওয়া। লোকের টাকা লুট না করে আর এ দেশে কে শিল্পপতি? কে সভাপতি? সাধারণ মানুষকে না ঠকিয়ে এদেশে আর কে সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান?

কিন্তু সব কিছুর শেষেও, মনে রাখা দরকার, একটা দেশ কোনো গোষ্ঠীর সীমানা ঘিরে পাচিল দেওয়া মানচিত্র নয়। এই দেশ, এখানে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকটি মানুষের, সমান অধিকারের-দায়-দায়িত্বের। মনে মনে ভাবি, নিশ্চয়ই এ অবস্থা পাল্টাবে। পাল্টানো তো কোনো ইতিহাস-জাবর কাটা সুবিধাভোগী প্রবীণেরা করবেন না, বরং তারা পরিবর্তনে বাধাই দেবেন, নিশ্চিত।  কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে গিয়ে ১৯৭১ সালের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সচেতন তারুণ্য দেশটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেবে, যাতে তারা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে।

কারণ, আজকের বাংলাদেশ বলতে এককথায় যেখানে ব্যাংক লুট, খুন-গুম-হত্যা-ধর্ষণ কোনো ব্যাপারই না। বিচার হবে না। রাষ্ট্র মিথ্যাচার করে সমস্ত মানুষকে খুব শিশু শিশু ভাববে, আর বলবে ‘ক্রসফায়ার’ বলে একটা ব্যাপার আছে। ‘ক্লিন হার্ট’ বলে একটা ব্যাপার আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র শক্তি একজন সন্দেহভাজনকে ধরে রাতে তার হার্ট ক্লিন করবে, সকালে তার লাশ পাওয়া যাবে। ব্যক্তির যদি সভ্য হয়ে উঠবার থাকে, রাষ্ট্রের থাকবে না? এই প্রশ্ন আপনাকে নয়, আমাকেই করছি। কিন্তু আমার কাছে এর উত্তর নেই। আমি অসভ্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছি না, নাকি চাচ্ছি না? সেটা বলা যাচ্ছে না।

এর মধ্য দিয়ে, পৃথিবীতে আমরা বাঙালির কোন চরিত্র দাঁড় করাচ্ছি? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নাগরিক কী বলবেন?

এর মধ্যেই ‘এসো হে বৈশাখ’। এর মধ্যেই ঢাক গুড়গুড়। ভাবছি, ইচ্ছে করলেই, বাংলাদেশকে আমরা আমাদের ক্রিকেট টিমের মতো একটা সম্মানজনক কন্ডিশনে নিয়ে যেতে পারতাম। এখনো পারি। এখন সেটা নেব কিনা, এই বৈশাখ, নববর্ষে সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।

আমরাই তো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি সুন্দর সভ্য দেশে পরিণত হোক, যে কোনো প্রকার উৎপীড়ণ-নিপীড়ণ বন্ধ হোক- কে চায় না? কারা চায় না? কেন চায় না? নিজের দেশের উন্নতিই আমার উন্নতি, এটা বুঝছি না আমরা? নাকি চোরের খনি শ্রমিক হতেই থাকব?

৪ এপ্রিল ২০১৬



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়