ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পা নয় যেন পাটকাঠি

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পা নয় যেন পাটকাঠি

পাঠক, সেই গল্পটি মনে আছে? সেই যে, শরীরের সব অঙ্গ যখন বলল, পেটের আসলে কোনো কাজ নেই, সে শুধু বসে বসে খায়! পেট তখন খাওয়া বন্ধ করে দিলো। এরপর? হ্যাঁ, এরপরেই শরীরের অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে লাগল। পুষ্টি না পেয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। তখন তাদের ভুল ভাঙল। তারা বুঝতে পারল পেটেরও কাজ আছে।

আইজলের পেট নয়, দুই পা ছিল জীবিকার অন্যতম অবলম্বন। ওই পেটের জন্যই; পেটপুরে দু’মুঠো ভাতের জন্যই তাকে পায়ে ভর দিয়ে চলতে হতো। উত্তাল সমুদ্র, নদীর মোহনায় সে ছুটে যেত জাল নিয়ে, মাছের আশায়। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে চলত সংসার। উপার্জনের এই একটি পথও যে রুদ্ধ হয়ে যাবে, কখনো ভাবেননি আইজল! অথচ মানুষ যা না-ভাবে, সৃষ্টিকর্তা বহু আগেই তা লিখে রাখেন ভাগ্যে। আর ভাগ্য কখনও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আইজল যেমন এড়িয়ে যেতে পারছেন না তার অসহায়ত্ব। পঙ্গু শরীর নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুড়বেন সাহায্য চেয়ে সে সামর্থও এখন তার নেই। 

অথচ সেদিন সকালও ছিল আলো ঝলমল। নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেকদিন নদীতে ইলিশ ধরতে যাওয়া হয়নি। নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হয়েছে। জেলে পাড়ায় আনন্দ যেন উপচে পড়ছে। সবাই যে যার মতো প্রস্তুত হচ্ছেন নদীতে নৌকা ভাসানোর। আইজল টুকটাক প্রস্তুতি আগের দিনই নিয়ে রেখেছিলেন। সকাল হলেই অনেকের সঙ্গে উঠে যাবেন ইলিশের নৌকায়। সকাল হলো বটে, কিন্তু আইজলের ভাগ্যে নেমে এলো ঘোর অমাবস্যার আঁধার। আইজল হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেলেন। নদীতে যাবার জন্য বাঁশ সংগ্রহ করছিলেন তিনি। আচমকা পড়ে যাওয়ার পর আর উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। লক্ষ্য করলেন, পা দুটো যেন পাথর! নড়াতে পারছেন না হাজার চেষ্টাতেও।

 

 

সেদিন আসলে আইজল নয়, মাটিতে পড়ে গিয়েছিল পুরো পরিবার। কেন এমন হলো, কীভাবে চিকিৎসা মিলবে, কোথায় গেলে ভালো হবেন আইজল- কেউ জানেন না! সঙ্গে সঙ্গে যে তাকে হাসপাতালে নেয়া হবে, সে টাকাও ছিল না ঘরে। দিনের পর দিন যায়, কিন্তু আইজলের আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না। পড়শীদের পরামর্শে কিছু টাকা সাহায্য তুলে আইজলকে নেয়া হয় নোয়াখালী মাইজদি শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেও ধরা পড়েনি আইজলের রোগ। পরিবারের ধারণা, অবশ হয়ে গেছে পা। যাকে বলা হয় প্যারালাইসিস। কিন্তু এসব কথার ভিত্তি নেই। মাইজদি হাসপাতালের ডাক্তার বলেন, ঢাকার আগারগাঁওয়ের নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু কে নিবে আইজলকে সেখানে? পথ-ঘাট অচেনা। এতো টাকাই বা কোথায়? কোনো উপায়ই খুঁজে পায়নি তার পরিবার। গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজের পর আইজলের চিকিৎসা খরচের জন্য সমাজের মানুষের কাছে টাকা উঠানোর প্রস্তাব উঠেছিল। তাতেও তেমন সাড়া মেলেনি।

দুই ছেলে, দুই মেয়ে, স্ত্রী রিজিয়া বেগমকে নিয়ে আইজলের সংসার। কী আর এমন বয়স! বয়সের সীমানা সবে ৩০ ছুঁয়েছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার দক্ষিণ চর মার্টিন ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে শ্বশুর বাড়িতেই থাকেন তিনি। শ্বশুর আবদুর রশিদ মারা গেছেন অনেক আগে। অবস্থার অবনতি দেখে শ্বাশুড়ি তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে রেখেছেন। শাশুড়ির বয়স একশ’র উপরে। বৃদ্ধ বয়সে তিনিও আইজলের চিকিৎসার খরচ চালাতে অপারগ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আইজলকে ঘর থেকে একজন ধরে নামাচ্ছেন খুব সাবধানে! এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি চেয়ারে বসলেন। পা দু’টো শুকিয়ে এমন হয়েছে, মনে হচ্ছে পাটকাঠি! রক্ত-মাংস নেই বললেই চলে, হাড় দুটো ছাড়া! বললেন তার হতভাগ্য জীবনের কথা। আগে বড় কোনো রোগ হয়েছে এমনও তার মনে পড়ে না। তাহলে হঠাৎ কোন দোষে তার এই পঙ্গু জীবন আইজল জানেন না। এই প্রতিবেদককে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, গরিব মানুষ, কেন এমন হলো, কী করলেই বা এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব জানি না। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।     

দারিদ্র্যের কারণে থমকে আছে আইজলের চিকিৎসা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আইজলকে যত দ্রুত সম্ভব রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে নিতে হবে। যত দিন যাচ্ছে আইজলের পা ভারি হচ্ছে। এই সমাজের বুকেও কি অবহেলার পাথর চেপে বসছে না?



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়