ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাসের হার আন্তর্জাতিক পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ৯ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাসের হার আন্তর্জাতিক পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ

মাছুম বিল্লাহ : এবার এসএসসি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে গত ৬ মে।  দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ফল বের হলো। দেখা গেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে। ছাত্রদের তুলনায় ১ দশমিক ৫৩শতাংশ ছাত্রী বেশি পাস করেছে। ছাত্রদের  তুলনায় ৫২ হাজার ৬৯২ জন বেশি ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। এ বছর আরো একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয়েছিল তারা কড়াকড়ির কারণে বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। দেশের খ্যাতনামা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা টেস্ট পরীক্ষাগুলো অত্যন্ত কঠিন ও কড়াকড়ির মধ্যে নিয়ে থাকে। সেখানে যারা ফেল করে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার্থে বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয় না। এভাবে স্কুলগুলো সুনাম অর্জন করার চেষ্টা করে। বিষয়টি এবার জাতীয় ক্ষেত্রেও ঘটেছে অর্থাৎ বিদ্যালয়ে টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয় নি। ফলে, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও কমেছে। এ রকম ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ। এটি কতটা আনন্দের আর কতটা যুক্তির কথা সেটি অবশ্য ভেবে দেখার সময় হয়েছে। কারণ কিছু বিষয়ের শিক্ষক ও বিদ্যালয় প্রশাসন চতুর ও দুরন্ত শিক্ষার্থীদের কায়দা করে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়ে পরীক্ষা দিতে দেয় না। এ রকম ঘটনা রাষ্ট্রীয় বৈধতা দেয়ার মানে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবিচার করা।

এবার গণিতের প্রশ্ন নাকি অনেক কঠিন হয়েছে। বিশেষ করে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য।  সিলেট বোর্ডের প্রায় ২৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে গণিতে। বরিশাল বোর্ডের ১৯ শতাংশ, ঢাকা বোর্ডের ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে। গণিতের প্রশ্ন পদ্ধতি সৃজনশীল হওয়ায় সারাদেশে গণিত সেভাবে পড়ানোর মতো উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে পরীক্ষা ফলে। এ ধরনের মন্তব্য করেছেন কিছু শিক্ষক এবং শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এবার গণিতের প্রশ্নে অবশ্য উদাহরণ থেকে অংক এসেছে যা অনেক শিক্ষার্থী করে না। তারা নোট ও গাইড বইয়ের অংক করে। তার অর্থ এই নয় যে, প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল। বরং বলা যায় শিক্ষার্থীরা গণিতের মূল বিষয় বা বেসিক বিষয় শেখে না বা শেখানো হয় না বলে এই অবস্থা হয়েছে। এবার সারাদেশে ফেল করেছে তিন লাখ ৭৮হাজার ৬৫০ জন। এর মূল কারণ গণিতের ফল খারাপ হওয়া। এদের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী মানবিক বিভাগের। বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেছে ৯৪.৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী, ব্যবসায় শিক্ষা ৮৩.০৩ শতাংশ কিন্তু মানবিক বিভাগে পাস করেছে মাত্র ৭৪.৩২ শতাংশ। ফলে মানবিক বিভাগে ফল বিপর্যয় ঘটেছে। যার ধাক্কা লেগেছে সার্বিক ফলাফলে। মানবিক বিভাগের এত বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থী যে অকৃতকার্য হয়েছে এর দায়ভার কে নেবে?

ইংরেজি প্রশ্ন নাকি এবার ভালো হয়েছে আর তাই  সারাদেশেই এ বিষয়ের ফল ইতিবাচক হয়েছে। সব বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি। পাসের হারে দেশের শীর্ষে থাকা রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে রাজশাহী বোর্ডের এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা প্রায় শতভাগ ইংরেজিতে দক্ষ। তারা ইংরেজি শুনে বুঝতে পারে, ইংরেজিতে সহজেই ভাব আদান-প্রদান করতে পারে, তারা ইংরেজিতে তাদের শ্রেণি অনুযায়ী যে কোনো লেখা পড়ে তার মর্মোদ্ধার করতে পারে এবং তাদের পরিচিত যে কোনো বিষয়ের ওপর শুদ্ধ ইংরেজিতে প্রবন্ধ বা রচনা লিখতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে আসলে ঘটনা কি তাই? একইভাবে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৭ দশমিক ৩৫ ভাগ আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে তা ৯৬ দশমিক ৯৩ ভাগ। ইংরেজির এই নম্বর গবেষণার দাবি রাখে। আমি প্রায় প্রতিমাসেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াই, বিদ্যালয়ে যাই, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি। তাদের ইংরেজির যে অবস্থা তাতে বিশাল প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, ইংরেজিতে তারা এত নম্বর কিভাবে পায়? দশম শ্রেণির একটি ক্লাসে একশ বা একশর কাছাকাছি শিক্ষার্থী কেউই যখন ইংরেজিতে বলতে পারে না- আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি/ আমরা দশম শ্রেণিতে একশ ছাত্রছাত্রী অছি/ আমি প্রতিদিন স্কুলে আসি/ আমি গতকাল স্কুলে আসিনি’ তাহলে আমরা তাদের কিভাবে মুল্যায়ন করলাম? এসব প্রশ্ন অতি সম্প্রতি আমি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেউই উত্তর দিতে পারেনি। ইংরেজি শেখানোর যে উদ্দেশ্য, যে শিখন ফল শিক্ষার্থীদের অর্জন করার কথা তা যখন করতে পারছে না তাহলে আমরা কিসের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের গ্রেডিং করছি? এই ফল কি শিক্ষার্থীদের আসলে ইংরেজিতে দক্ষতার কথা তুলে ধরে?

এবার এসএসসি পরীক্ষায় আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪ হাজার ৫৫৬ জন শিক্ষার্থী। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৩শতাংশ। তবে জিপিএ-৫ কমেছে। গত ছয় বছরের মধ্যে এবারই প্রথম আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তি লাখের নিচে নেমে গেছে। চতুর্থ বিষয়ের নম্বর এবার যোগ না হওয়ায় অনেকেই কাঙ্খিত ফল পায়নি। গতবারের চেয়ে পাসের হার বেড়েছে সাড়ে চার শতাংশ তবে জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে বলা যায় ধস নেমেছে। তবে যশোর বোর্ডে গত বছর পাসের হার ছিল ৭৬.৬৪ শতাংশ যা এবার হয়েছে ৯০.৮৮ শতাংশ। এর পেছনে কি যাদু রয়েছে যে, সমস্ত সিসুয়েশন একই থাকার পরেও একটি বোর্ডে হঠৎ করে পাসের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল? বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষার স্বার্থেই ভেবে দেখতে হবে।

পরীক্ষকদের খাতা দেয়ার আগে প্রশিক্ষণ জোরদার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। সেখানে তাদের একটি করে মডেল উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয় যাতে সবাই কাছাকাছি নম্বর দিতে পারেন। এগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট উত্তরপত্র মূল্যায়ণ যাতে সঠিকভাবে হয় সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এটিও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আমাদের দেশের কত শতাংশ শিক্ষক এখনও টেস্টিং ইলিটারেসিতে ভুগছে সেটি কিভাবে দেখা হবে বা হচ্ছে। এই বিষয়টি মিনিমাইজ হবে কবে? কবে একটি নির্দিষ্ট হারে শিক্ষকগণ টেস্টিং লিটারেট হবেন সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দিষ্ট টার্গেট থাকা প্রয়োজন। তা না হলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। আমাদের পাবলিক পরীক্ষায় পাসের এই হার আন্তর্জাতিক পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তাও ভেবে দেখতে হবে।  প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্স অ্যাসেসমন্টে বা পিসার মানদণ্ডে আমরা কোথায় অবস্থান করছি সেটি দেখারও এখন উপযুক্ত সময়।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়