ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পাহাড় ধস রোধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২৩ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড় ধস রোধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন

রুহুল আমিন : বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই কয়েকদিনের টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও কক্সবাজারে পাহাড় ধসে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেছে। কেবল শুরু বর্ষার, তাই সামনের দিনগুলোতে আরো বৃষ্টি হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

পাহাড় ধসে ১৫৬ জন নিহত হওয়ার কয়েকদিন আগেও পাহাড়ে বাঙালি-পাহাড়ি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলছিল। এক বাঙালি যুবলীগ নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয় পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে। হঠাৎ পাহাড় ধসের ঘটনায় সেই উত্তেজনার কথা আমরা সবাই ভুলে গেলাম।

পাহাড় ধসে এই প্রাণহানির ঘটনাও ইতোমধ্যে আমরা ভুলতে বসেছি। ১৫৬ জনের প্রাণহানিতে যেন কিছুই হয়নি আমাদের। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখা যায়নি। তার চেয়ে বরং ভারত-পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন ট্রফির ফাইনাল, ১৫ % ভ্যাট আর হালে  ‘ঈদ’ হবে না ‘ইদ’ হবে এই আলোচনা চলছে ব্যাপক।

আমরা যারা সমতলে বাস করি তারা হয়তো বুঝতেই চেষ্টা করি না পাহাড়ের প্রকৃত সমস্যা কি। এই যে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত, দু’একদিন টানা বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসে মানুষ মারা যাচ্ছে এর নিশ্চয়ই কারণ আছে। পাহাড়ের পাদদেশে কারা ঘর নির্মাণ করছে? কোথায় থেকে আসছে? পাহাড় ধসের ঘটনার পর বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পাহাড় ধসে নিহতের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই বাঙালি।

আশ্চর্যজনক হলেও এই তথ্যটা সত্য। আর এই সত্যটার পেছনেই লুকিয়ে আছে পাহাড় সংক্রান্ত যত সমস্যা। পাহাড়ে সমতলের নিম্নবিত্তরা কেন যাচ্ছে, কারা তাদের সেখানে আবাস গড়ে দিচ্ছে, কারা পাহাড় কাটছে এইসব বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার এই মুহূর্তে। না হয় সামনে আরো ভয়বহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে। সাম্প্রতিককালে পাহাড় ধস যেমন পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধ জিইয়ে রাখল, তেমনি হয়তো পাহাড় ধসে নিহতের কারণে কিছু তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করবো। তারপর কয়েকদিন গেলে আমরা সব কিছু ভুলে যাব। কারণ, এই মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনকে খুব একটা আন্দোলিত বা আলোড়িত করেছে বলে মনে হয় না।

প্রান্তিক মানুষ হতাহতের বিষয় নিয়ে কেন্দ্রের মানুষের অতটা ভাবতে যেন মানা। তাছাড়া তারা (প্রান্তিক মানুষ) রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী নয়, আবার অর্থনৈতিক দিক দিয়েও স্বাবলম্বি নয়। হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই সদস্যরা মরলেই কি বা বাঁচলেই কি, আমাদের মতো যারা কেন্দ্রে বাস করে তাদের তাতে কিছু যায় আসে না যেন।

পাহাড়ে এই প্রাণহানি আমাদেরকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি কখনো। অথচ কাদের কারণে, কারা এর জন্য দায়ি- এই প্রশ্নগুলো আমাদের তোলা দরকার ছিল। তাছাড়া সমতলের উন্নয়ন চিন্তার থিউরিই পাহাড়ের জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রেও পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ, সমতলের উন্নয়ন প্রকল্প পাহাড়ের সঙ্গে মিলতে পারে না। প্রায় প্রতিবছরই পার্বত্য চট্টগ্রামে অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচুর কাজ হচ্ছে। কিন্তু সব জায়গায় সমতলের থিউরি প্রয়োগের কারণে বিপর্যয় এড়ানো যাচ্ছে না। পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষা হচ্ছে না। প্রাণ প্রকৃতির দাবি রক্ষা হচ্ছে না। আর এইসব কারণে বিপন্ন হচ্ছে পাহাড়ের প্রাণ প্রকৃতি জীবন। বিপন্ন হচ্ছে আমাদের পাহাড়। এর সঙ্গে আছে দুর্নীতি আর বাণিজ্যিকীকরণের নামে পাহাড়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এমনকি পাহাড়ের চাষ-বাসেও সমতলের ভাবনা প্রয়োগ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাহাড় ধসে মৃতের সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জুনে চট্টগ্রামের লেবু বাগানে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। আর ৮ বছরে বাকি প্রায় ৭০জনের প্রাণহানি হয়। গত ১১ জুন ১২৭ জনের মৃত্যুর এক দশক পূর্তিতে পাহাড়ে ব্যাপক ধসের আশঙ্কা করেছিলেন পরিবেশবাদীরা। কারণ, গত ২৫ বছরে শুধু চট্টগ্রাম আর এর আশপাশেই কাটা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার পাহাড়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তার দুই দিন পরেই পাহাড় ধসে ১৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটল।

২০০৭ সালে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করেছিল। পাহাড় রক্ষা এবং ধস ঠেকাতে প্রণয়ন করেছিল ৩৬ দফা সুপারিশ। দুঃখের বিষয় যে, গত এক দশকেও বাস্তবায়ন হয়নি একটি সুপারিশও।

যথারীতি এবারের ঘটনার পরও প্রশাসন থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলো। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার।

সরকারের সদিচ্ছা নেই- এ কথা বলবো না। কিন্তু তৃণমূলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা পাহাড় কাটার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গোয়ার্তুমির কাছে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের চাপ কাজে আসে বলে মনে হয় না। তাছাড়া দেশের হাজার হাজার সঙ্কটের মধ্যে এক সময় পাহাড়ের সঙ্কটও তলিয়ে যায়।

পাহাড় কাটা, পাথর সংগ্রহ, গাছ কেটে রাস্তা করা, অপরিকল্পিত গৃহায়ণ ও আরো অনেক কারণে পাহাড়ে ধস নামে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে পাহাড়ের নিজস্ব বনভূমি বিলীন করে।তাছাড়া বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারিভাবে দেওয়া হয় ইজারা। আর পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দৌরাত্মা তো আছেই। সব মিলিয়ে পাহাড়ের এই প্রাণহানিকে কোনোভাবেই মৃত্যু বলা যাবে না। আর এ দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। সরকারের উচিত এখনি পাহাড় ধসের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। কারা কারা, কোন কোন অবস্থায় পাহাড় ধসের সঙ্গে জড়িত তা খতিয়ে দেখে নেওয়া। অন্তত পাহাড়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় না দিয়ে মানবিক মূল্যবোধে এগিয়ে যাবে সরকার দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বর্তমান সরকারের কাছে এটাই প্রত্যাশা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৭/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়