ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

পিনাক-৬ লঞ্চডুবি : শাস্তি নিয়ে সংশয়

নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ১৬ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পিনাক-৬ লঞ্চডুবি : শাস্তি নিয়ে সংশয়

নাসির উদ্দিন চৌধুরী : মাওয়ায় পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে গণ্য এক কর্মকর্তাকে দুর্ঘটনার ১১ দিনের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করায় এবং অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই সংশয় দেখা দিয়েছে।

এ ছাড়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিও ইতিমধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তদন্ত কমিটিতে নৌ-প্রকৌশলী কিংবা জাহাজ জরিপকারক না থাকায় বিশেষজ্ঞরা এই কমিটিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে পুনর্গঠনের দাবি জানালেও তা আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর (ডস) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য, প্রত্যক্ষদর্শী ও লঞ্চের বেঁচে  যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ধারণক্ষমতার চারগুন বেশি যাত্রী নিয়ে এবং আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে লঞ্চটি চালানোর কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এজন্য বিভিন্ন মহল থেকে চারজন কর্মকর্তাকে সরাসরি দায়ী করা হয়। তাঁরা হলেন, মাওয়া অঞ্চলে নৌযান চলাচল তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার, একই সংস্থার পরিদর্শক শফিক আইয়ুব, বিআইডব্লিউটিএ-এর পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর ভুঁইয়া এবং একই সংস্থার উপ-পরিচালক ও মাওয়া নদীবন্দর কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমেদ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিনাক-৬ ডুবির পর থেকেই এই চার কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়ার জোরালো দাবি উঠলেও সংশ্লিষ্ট দুটি সংস্থা তাঁদের বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে নিরব রয়েছে। তবে পিনাক-৬ দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও উদ্ধার তৎপরতায় ব্যর্থতার জন্য ওই চার কর্মকর্তাসহ ডস ও বিআইডব্লিউটিএ-এর আট কর্মকর্তার শাস্তি দাবি করে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। গত ১৩ আগস্ট নৌ-সচিবসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে একটি আইনি নোটিশও পাঠানো হয়।

এরপরই বিআইডব্লিউটিএ-এর পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর ভুঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। আর দায়ী হিসেবে গণ্য অন্য কর্মকর্তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ ছাড়া আইনি নোটিশে উল্লেখিত দায়ীদের মধ্যে অন্যতম মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে আকস্মিকভাবে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের সদরঘাট (ঢাকা) কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গত ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় এই অফিস আদেশ [স্মারক নং ৩৭৮৪ (১৬), তারিখ: ১৫.৮.২০১৪] জারি করেন।

এই লঞ্চডুবিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চাঞ্চল্য সৃষ্টিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে তীব্র ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। ডস মহাপরিচালকের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ এর বিপরীতে ‘দুষ্টের লালন’ হিসেবেই মন্তব্য করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় এমভি শাথিল-১ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পর লঞ্চটির নিবন্ধন ও ফিটনেস প্রদানকারী কর্মকর্তা মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বরিশাল কার্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত (দায়িত্বহীন) করা হয়। তবে গত ১৫ জুলাই তাঁকে মাওয়া অঞ্চলে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডস মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত [স্মারক নং ৪৩৬৭ (১২), তারিখ: ১৪.০৮.২০১৪]
অফিস আদেশে বলা হয়, নৌ দুর্ঘটনা রোধে আরও সতর্কতা অবলম্বনের লক্ষ্যে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য গত ১ জুন ২০১৪ তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চ, স্পিডবোট ও অন্যান্য নৌযানের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিতকরণ, অনিবন্ধিত নৌযানকে আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নৌযানের রেজিষ্ট্রেশন ও সার্ভে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে দায়িত্ব প্রদান করা হলো। এছাড়া তিনি ঈদ উপলক্ষে মাওয়া ঘাটে অধিদপ্তরের পক্ষে সমন্বয়ক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বরিশাল কার্যালয় থেকে প্রত্যাহারকৃত এই কর্মকর্তাকে মাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি সে দায়িত্ব পালন করেননি। পিনাক-৬ দুর্ঘটনার দিন কর্মস্থলে না গিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে চরম উদাসীনতা ও গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

গত ৪ আগস্টে লঞ্চ দুর্ঘটনা ও ব্যাপক প্রাণহানির জন্য এই কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতা অনেকাংশেই দায়ী বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। অথচ সেই মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে শাস্তির পরিবর্তে ঢাকার সদরঘাট কার্যালয়ে পদায়ন দিয়ে কর্তৃপক্ষ কার্যত তাঁকে পুরস্কৃত করেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া গত ৭ আগস্ট নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে নৌমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সারাদেশে অনিবন্ধিত ও ত্রুটিপূর্ণ নৌযান সনাক্তকরণের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির আহ্বায়কও করা হয়েছে তাঁকে। প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ১৭ মে মানিকগঞ্জের আরিচায় যমুনা নদীতে এমএল রায়পুরা দুর্ঘটনায় দু’শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু ও এর দু’দিন আগে ১৫ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় এমভি প্রিন্স অব পটুয়াখালী দুর্ঘটনায় অর্ধশত যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত আলাদা তিনটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে দায়ী করা হয় এবং তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়।

ওইসব ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে দুটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাজ জরিপকারক মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে সদরঘাট কার্যালয়ে পদায়ন করার কথা আমি শুনেছি। যেহেতু সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের বিকালে আদেশ হয়েছে এবং আমি তার আগেই অফিস থেকে চলে এসেছি, সেহেতু আদেশটি আমি পড়ে দেখেনি। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবো না ।’

এমএল পিনাক-৬ দুর্ঘটনার পর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুরুর রহমানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের (আইএসও-১৯৭৬) ক্ষমতাবলে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পরীক্ষক এবং প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক ড. এ এস এম নাজমুল হকের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মহাপরিচালক আটদিন পর অধিদপ্তরের কমিটি বিলুপ্ত করেন। বিশ্লেষকরা বলেছেন, এক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের কমিটি নিয়ে। সাত সদস্যের কমিটিতে যুগ্মসচিব ছাড়া যে ছয় জনকে প্রথমে রাখা হয়েছিল তাঁরা হলেন, বিআইডব্লিউটিএ-এর সদস্য (প্রকৌশল) নৌ স্থপতি ফিরোজ আহমেদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নৌস্থপতি গৌতম কুমার, বিআইডব্লিউটিসি-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রহিম (যন্ত্র প্রকৌশলী), সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে এম জসিমউদ্দীন সরকার এবং মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক।
পরবর্তী সময় মাদারীপুরের জেলা প্রশাসককে বাদ দিয়ে তদন্ত কমিটিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নির্বাহী হাকিম সাইফুল হাসানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উচ্চপর্যায়ের এই কমিটিতে দুজন নৌস্থপতি ও একজন যন্ত্র প্রকৌশলী রাখা হলেও নৌযানের ফিটনেস যারা পরীক্ষা করেন সেই জরিপকারকদের কাউকে রাখা হয়নি। এমন কি একজন নৌ প্রকৌশলীও নেই কমিটিতে। ফলে এই কমিটি ত্রুটিপূর্ণ এবং এর তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা যথাযথ হবে না এবং তা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

বুয়েটের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আব্দুর রহিম বলেন, ‘নৌ মন্ত্রণালয়ের কমিটির পাশাপাশি সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কমিটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় আইনে কোনো বাধা নেই। অতীতে এমন ঘটনার নজিরও আছে।’

এ ছাড়া আইএসও-১৯৭৬ অনুযায়ী, নৌ-দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন এবং তদন্ত প্রতিবেদনসহ সুপারিশমালা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করার দায়িত্ব অধিদপ্তরের বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ আগস্ট ২০১৪/নাসির/শফিক/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়