ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পেনশনের টাকা দিয়ে বই

মামুন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ২ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পেনশনের টাকা  দিয়ে বই

নিজ পাঠাগারে সৈয়দ আব্দুল্লাহ

মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ:  বাংলা রম্য গদ্যের নির্মাতা বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ড. সৈয়দ মুজতবা আলী তার বাবার চাচাত ভাই । চাচার পরিচয়ে নয়, নিজেরই পরিচয় তৈরি হয়েছে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সৈয়দ আব্দুল্লাহ’র।

সিলেটে বিভাগজুড়ে লেখক, সাহিত্যিক হিসাবে নিজস্ব পরিচিতি পেয়েছেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ।এ যাবৎ ১৫টি গবেষণা মূলক গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে তার।

প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : গবেষণার আলোকে তরফ বিজয় (১৯৯১), আরাকানের মুসলমান (২০০১), মুসলিম মনীষা ১ম খন্ড (২০০১), মুসলিম মনীষা ২য় খন্ড (২০০৩), স্মৃতির পাতা থেকে (২০০২), পিতামহ এবং উত্তরাধিকার (২০০৮), পত্র সাহিত্য (২০০৯), আব্বাকে যেমন দেখেছি (২০০৯), চুনারুঘাটের আলোক উজ্জ্বল মনীষা (২০১০) ইত্যাদি ।

১৯৫১ সালে ৩ নভেম্বর বাহুবল উপজেলার উত্তরসুর গ্রামে জন্ম নিভৃতচারী এই লেখকের। ছাত্র জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু তার। পড়ালেখা শেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। একদিকে শিক্ষকতা অন্যদিকে লেখালেখি, এভাবেই সময় কাটে তার। সিলেটেও  লেখক হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। নিজের লেখা বেশকিছু পান্ডুলিপি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন পেনশনের টাকা দিয়ে।

শিক্ষার প্রসারেও কাজ করেন। গ্রামে বয়স্ক ব্যক্তিদের লেখাপড়া শেখাতে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আবার গ্রামের শিশুদের নিয়েও তিনি কাজ করছেন। তাকে ঘিরে হবিগঞ্জ অঞ্চলে সাহিত্যের একটি  বলয়ও তৈরি হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবেও তার রয়েছে বলিষ্ঠ অবদান । 

সৈয়দ আব্দুল্লাহ জানালেন, বর্তমানে ‘স্মৃতির আয়নায় মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি গ্রন্থের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। যা প্রায় সমাপ্তির পথে। দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনী।

নিজ বাসভবনে গড়ে তুলেছেন সমৃদ্ধ পাঠাগার, পুরাতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, তরফরত্ন ফাউন্ডেশন, খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দর আলী ফাউন্ডেশনসহ সেবামূলক নানা প্রতিষ্ঠান। সাহিত্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত গ্রন্থ প্রকাশ করছেন। নানা সভা, সেমিনারের মাধ্যমে তৃণমূলে প্রকৃত জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বই সৌজন্যমুলক উপহার দিচ্ছেন। যা নিভৃত জনপদে শিক্ষা ও সাহিত্যের আলো ছড়াচ্ছে।

তিনি গ্রামে পড়ে থেকে নিভৃতে কাজ করছেন আপন মনে। ৪৬ বছর যাবৎ গ্রামে  শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির আলো জ্বালাচ্ছেন। গবেষণামূলক লেখালেখির কারণে তিনি একজন শেকড় সন্ধানী গবেষক হিসেবে সমাদৃত। এসব দেখতে এবং তার কাছ থেকে ইতিহাসের তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করতে অনেক গবেষক এই নিভৃত গ্রামে ছুটে আসেন। এমন কী মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে তথ্যের জন্য কানাডিয়ান বিখ্যাত গবেষক ড. আয়েশা ইরানী তাকে ফোন করেছেন ।

গবেষণার জন্য তিনি ইতিমধ্যে আঞ্চলিকভাবে নানা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেয়েছেন। বিএনএসএ ইংল্যান্ড কর্তৃকও ১৯৯৬ সালে তাকে গবেষণা এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। বিশ্বকোষের একজন গবেষক হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন।

লন্ডন ভিত্তিক টিভি চ্যানেল এস তার জীবন ও কর্মের উপর ৩০ মিনিটের ‘আয়না ঘর’নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করে প্রচার করেছে। এ অঞ্চলের সর্বস্তরের সাহিত্যিকদের কাছে তিনি স্যার সৈয়দ আব্দুল্লাহ নামে পরিচিত।

 

সৈয়দ আব্দুল্লাহর মুখোমুখি প্রতিবেদক


ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য সংগঠন তরফ সাহিত্য পরিষদের তিনি বর্তমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্থপতি মহাকবি সৈয়দ সুলতান গবেষক হিসেবে তিনি পরিচিত। মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য গবেষণা পরিষদের তিনি প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারি। হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক।

২০০২ সালে বাহুবল উপজেলা সদরে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে শুরু করেন একুশে বই মেলা। ২০০৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাহুবল উপজেলাবাসী তাকে এক বিশাল গণসংবর্ধনার মাধ্যমে একুশে বই মেলাতে তরফরত্ন উপাধিতে ভূষিত করে। হবিগঞ্জের প্রাচীন নাম ছিল তরফ। এই তরফ অঞ্চল নিয়ে সবচেয়ে বেশি লেখালেখি ও গবেষণা করেছেন তরফরত্ন সৈয়দ আব্দুল্লাহ।

তার সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সিএম শফী সামী এক বক্তব্যে বলেছেন- ‘আপনি সারা দেশে খুঁজে এমন অপর একটি কাজের দৃষ্টান্ত হয়তো দেখাতে পারবেন না, যিনি জীবনের শেষ সম্বল অবসর ভাতা দিয়ে বই ছাপিয়েছেন। একজন দরিদ্র স্কুল শিক্ষক কিছু ধানের জমি কিনতে পারতেন। কোন ব্যবসা করতে পারতেন। তিনি এসবের কিছু না করে বই ছাপিয়েছেন। সব টাকা সাহিত্যের পিছনে ব্যয় করেছেন। সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কিছু কাগজের সম্পদ, কিছু জ্ঞানের ভান্ডার রেখেছেন। তার মতো গুণী মানুষকে রাষ্ট্রীয় ভাবে মূল্যায়ণ করা সময়ের দাবি।’

কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার বলেছেন, সৈয়দ আব্দুল্লাহ আমাদের সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য বিনির্মাণের এক দিকপাল। নিভৃতচারী গবেষক।  বিত্তর পিছুটান তার চিত্তকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। জাতীয়ভাবে তাকে মূল্যায়ণ করা প্রয়োজন।     

 

 

রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/২ মার্চ ২০১৭/মো. মামুন চৌধুরী/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়