ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য বাবার নিরন্তর আইনি লড়াই

মেহেদী হাসান ডালিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০২, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য বাবার নিরন্তর আইনি লড়াই

মেহেদী হাসান ডালিম : পিতা হিসেবে অনন‌্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মোস্তাফিজুর রহমান। বোবা হোক, কালা হোক-আমার সন্তান আমার কাছে অতি আদরের। প্রতিবন্ধী ছেলের জন‌্য নিরন্তর আইনী লড়াই করে সে কথারই প্রমাণ দিলেন মোস্তাফিজুর। পুত্রের ভবিষ‌্যতের জন‌্য পিতার এই লড়াইয়ে জয়ী হওয়ায় অবশেষে হাসি ফুটেছে বাবার মুখে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান। তার বড় ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। আর ছোট ছেলে মোস্তফা মাসুদ জন্মগত ভাবে সেরিব্রাল পালসি প্রতিবন্ধী। ২০০২ সালে তার স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান মাসুদ। জন্মের পর থেকে প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশির নানা হতাশামূলক কথা শুনতে হয়েছে পিতা মাতাকে। কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে অবজ্ঞার ছলে বলেছে, এই প্রতিবন্ধী ছেলেকে দিয়ে কি করবে? এক বুক হতাশা আর মনোকষ্ট চেপে রাখলেও দমে যাননি আইনজীবী বাবা। শিশুটি জন্মের পর থেকেই সংগ্রাম করতে থাকেন তিনি।

মোস্তফা মাসুদকে নিয়ে চিকিৎসকের শরানাপন্ন হন বাবা। চিকিৎসক জানান, শারিরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হলেও মাসুদের ব্রেন ঠিক আছে, মানষিক ভাবে সুস্থ আছে। হাল ছাড়া যাবে না।

চিকিৎসকের এই কথায় রাজ‌্যের হতাশার মাঝে ক্ষীণ আলো দেখতে পান মোস্তাফিজুর। ছেলেকে পড়ালেখা  করিয়ে মানুষ করানোর স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। মাসুদকে মোহাম্মপুরের কিশলয় কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি করে দেন। এক পর্যায়ে মোহাম্মপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে  জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় মাসুদ। আশানুরুপ পরীক্ষা দিলেও ফলাফলে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে এক নম্বরের জন্য  অকৃতকার্য হয় মাসুদ।

পরে খাতা পুনঃমূল্যায়ন করতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন করা হয়।

বোর্ডের পক্ষ থেকে খাতা পুনঃমূল্যায়নে কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাইকোর্টে রিট করেন মাসুদের বাবা  অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান।

২০১৭ সালে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। রুল জারির পর টনক নড়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষের। আদালতের আদেশে মাসুদকে কৃতকার্য দেখানো হয়। এর ভিত্তিতে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয় মাসুদ। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় মোস্তফা মাসুদ। এবারও সে দুটি বিষয়ে (গণিত এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়) অকৃতকার্য হয়। গণিতে ৩২ নম্বর এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে ২৩ নম্বর পায় সে।  দুটি বিষয়ের খাতা পুনঃমূল্যায়নের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে সম্পূরক আবেদন করেন মাসুদের আইনজীবী বাবা। আদালত আবারও রুল জারি করেন।

এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ সব প্রতিবন্ধীদের জন্য যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন।

রায়ে সকল পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নে তিন মাসের মধ্যে বিধি প্রণয়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোস্তফা মাসুদের দুটি বিষয়ের খাতা সাবধানতার সাথে পূনঃমূল্যায়ন করে যথাযথ নম্বর দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মোস্তফা মাসুদের রেজাল্ট সিট তৈরির নির্দেশ  দিয়েছেন আদালত।

রায়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালা রয়েছে। তেমনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেরও একটি নীতিমালা আছে। কিন্তু সেই নীতিমালায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র কিভাবে মূল্যায়ন করতে হবে তার উল্লেখ নেই। তাই শিক্ষার্থী কোন ধরণের প্রতিবন্ধী তা বিবেচনা করে সেভাবেই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা উচিত। রায়ে বলা হয়, দেশে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের জণ্য বিশেষ যত্ন ও সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওইসব সুবিধা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

আদালত বলেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময় দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু পরীক্ষার পর পরীক্ষক যাতে সতর্কতার সাথে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। এ নিয়ে নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। কারণ তারা (প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী) সমাজের অপরাপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো নয়।

রায়ে আরো বলা হয়, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এর ১৬(১) ও (২) ধারায় শিক্ষার সকল স্তরে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা ব্যক্তি কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না।

রায়ের পর  প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য আইনী লড়াই করে আসা অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, আজ আমার জন‌্য খুব খুশির দিন।  যাদের ঘরে প্রতিবন্ধী সন্তান আছে, কিন্তু পড়ালেখা করাতে সাহস পাচ্ছেন না তাদের ইনকারেস করার জন্য আমি ফাইট করেছি। আমার আইনী লড়াই সফল হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী সন্তানদের বোঝা মনে না করে  তাদেরকে যুগপোযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আমার প্রতিবন্ধী ছেলে মাসুদকে মানুষের মত মানুষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। আমি মনে করি আজকের রায় প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে মাইল ফলকের ভূমিকা পালন করবে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯/মেহেদী/নবীন হোসেন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়