ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৮, ৮ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক

রুহুল আমিন : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যাকে প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি।

বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তার লেখালেখিতে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের বিষয়টিও স্থান পেয়েছে। গীতার ব্যাখ্যাদাতা ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও ছিলেন খ্যাতিমান। বিখ্যাত এই ঔপন্যাসিকের প্রয়াণ দিবস আজ।১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ২৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের কাছাকাছি কাঁঠালপাড়ায় জম্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। যাদবচন্দ্র ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী।

শৈশব থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। পাঁচ বছর বয়সে পুরোহিত বিশ্বম্বর ভট্টাচার্যের কাছে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি । আর গ্রামের পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার ছিলেন গৃহশিক্ষক। যদিও বঙ্কিমচন্দ্র গ্রামের পাঠশালায় যাননি কোনোদিন।

১৮৪৪ সালে বাবার কর্মস্থল সূত্রে মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন বঙ্কিমচন্দ্র। ইংরেজি মাধ্যমে কয়েক বছর পড়ার পর ১৮৪৯ সালে জন্মস্থান কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র। সেখানে শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। ওই বছরই হুগলি কলেজে ভর্তি হন তিনি।

১৮৫৩ সালে হুগলি কলেজে পড়ার সময় জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন তিনি।  আর ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে দুই বছরের জন্য ২০ টাকা বৃত্তি পান। তবে একই বছর তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

১৮৫৭ সালে জানুয়ারিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। বঙ্কিমচন্দ্রসহ মোট ১০ জন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পরীক্ষা দেয়। কিন্তু কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

পড়াশোনা শেষে বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ৩০ বছরের বেশি সময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে চাকরি করেন তিনি। ১৮৯১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অব দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাবে ভূষিত করে তাকে।

১৯৪৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিয়ে করেন নারায়ণপুর গ্রামের ৫ বছর বয়সী মোহিনী দেবীকে। ১৮৫৯ সালে মোহিনী দেবীর মৃত্যু হয়। পরে ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালিশহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীকে বিয়ে করেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি দুটি ছোট কবিতা লিখেন। আর হুগলি কলেজে পড়ার সময় তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার আদর্শে ‘সংবাদ প্রভাকর’ও ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’-এ  গদ্য, পদ্য লিখতেন। ১৮৫৩ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২০ টাকা পুরস্কার পান। সমগ্র জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র ৪২ বছরের সাহিত্যসাধনা করেন। কমলাকান্ত ছদ্মনামেও লেখালেখি করেন তিনি।

ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শেষজীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল এই ৪২ বছর। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তিনি শেষ লেখা লেখেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৪টি।

ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তবে লেখক ও হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি বেশি বিখ্যাত। তিনি বিখ্যাত বঙ্গদর্শন (১৮৭২-১৮৭৬) পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে একটি নতুন লেখকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তার লেখনিতে প্রাচীন ভারতের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে।

ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। চাকরি জীবনে খুলনায় পোস্টিংয়ের সময় তিনি ‘Rajmohan’s Wife’ নামে একটি ইংরেজি উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস দিয়েই তার সাহিত্য জীবনের আরম্ভ। এই উপন্যাস দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। বাঙালির রোমান্টিক সত্তার এক নতুন জাগরণ ঘটে তার উপন্যাসে। তার তিনটি উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘মৃনালিনী’ তারই উকৃষ্ট প্রমাণ।

পরে বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে তার নতুন পরিচয় ও মেথার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এই মাসিক পত্রিকায় তিনি পরপর ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি উপন্যাসের সঙ্গে নানা বিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখতে থাকেন।

বঙ্গদর্শনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান হলো প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার। দুবছর বন্ধ থাকার পর তার ভাই সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ আবার বের হয়। ‘রাধারাণী’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’এ সময়ের লেখা।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাসই ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, কানাড়া, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ হয়েছে মঞ্চে, হয়েছে চলচ্চিত্র। ভাষা ও উপন্যাসের কাঠামো তৈরির বিষয়ে তিনি ছিলেন পথপদর্শক। রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক উন্নতির সব রকম প্রয়াসে  অবিরাম লেখে গেছেন তিনি।  ঐতিহাসিক, রোমান্টিক, পারিবারিক- এই তিন ধারায় উতসারিত বঙ্কিমচন্দ্রের অ্যাখ্যানগুলি সমসাময়িক ও পরবর্তী সাহিত্য ও জীবনের ওপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে।

তার লেখা প্রবন্ধগুলো হলো  কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য, কৃষ্ণচরিত্র, বিজ্ঞানরহস্য, বিবিধ সমালোচনা, প্রবন্ধ-পুস্তক, সাম্য  ও বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খণ্ড : ১৮৮৭, ২য় খণ্ড : ১৮৯২)।

এছাড়া তার অন্যান্য কাজগুলো হলো ললিতা, ধর্ম্মতত্ত্ব অনুশীলন, সহজ রচনা শিক্ষা, শ্রীমদ্ভগবদগীতা  ও কবিতাপুস্তক। সম্পাদনা করেছেন দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, বাঙ্গলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী।

শেষ জীবনে তার স্বাস্থ্য তেমন ভাল ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তার বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে ওই বছরের ৮ এপ্রিল মারা যান তিনি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ এপ্রিল ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়