প্রেম ও দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
রুহুল আমিন : বাংলা সাহিত্যে প্রেম ও প্রতিবাদে উজ্জ্বল কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। প্রেম ও দ্রোহের মিশেলে রুদ্র শিল্পের মোড়কে জীবনকে, বাস্তবতাকে, সমাজকে, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে চিত্রিত করেছেন তার কবিতায়। তিনি কখনো ভুলে যাননি জাতির প্রতি দায়। আবার ভুলে যাননি অসহায় মানুষের প্রতি দায়িত্বও।
জাতির সংকট চোখে পড়লে কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে। ভয়-ভীতির বাইরে গিয়ে, সুযোগ সুবিধার লোভে আকৃষ্ট না হয়ে ক্ষমতায় থাকা জাতির বিশ্বাসঘাতকদের কথাও বলতে তিনি ভুলেননি। তখন তিনি উচ্চারণ করেন,
‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
বাতাসে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ—
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না—
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুণ্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারি না, আমি
ঘুমুতে পারি না...
…’(বাতাসে লাশের গন্ধ)
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, চেতনা যখন ভুলুণ্ঠিত হতে দেখেন রুদ্র তখন ব্যথিত হন। দ্রোহে ফেটে পড়েন। স্বাধীনদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান দেখে তিনি বেদনার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-
রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে
শকুনে খেয়েছে যারে, সে আমার ভাই,
সে আমার মা
সে আমার প্রিয়তম পিতা স্বাধীনতা
সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন স্বাধীনতা
সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি এ আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
(বাতাসে লাশের গন্ধ)।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ ও অস্থিরতাকে ধারণ করেছেন। কবিতায় লিখেছেন অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় নিয়ে। আবার দলবদ্ধ হয়েও তিনি কথা বলেছেন।
স্বৈরাচার সরকারের শাসনামলে ভাড়াটে কবিরা যখন এশীয় কবিতা উৎসব করে। রুদ্র তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যান জাতীয় কবিতা উৎসব নিয়ে। শুধু কবিতায় নিজেকে বন্দি রাখেননি রুদ্র। ৭৫ পরবর্তী জীবিত থাকা অবস্থায় প্রায় সবগুলো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সশরীরে অংশ নিয়েছেন তিনি।
প্রতিবাদী রোমান্টিক হিসেবে খ্যাত রুদ্র মুহম্মদ ১৯৯১ সালের ২১ জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। কবির প্রতি গ্রভীর শ্রদ্ধা।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বাবার কর্মস্থল বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল থেকে এস এস সি এবং ১৯৭৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচ এস সি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বি এ এবং ১৯৮৩ সালে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারি বহুল আলোচিত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন তিনি। তবে ১৯৮৮ সালে তাদের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে।
ভীষণ এক খামখেয়ালী জীবন যাপন করেছেন রুদ্র। মধ্যবিত্ত হলেও পারিবারিক স্বচ্ছলতা ছিল তার। কিন্তু সেপথে যাননি। ছিলেন ভিষণরকম প্রতিষ্ঠানবিরোধী। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে বাঁধেননি কখনো। তবে কয়েকটা রিকশা ছিল, তা থেকে যা আয় হতো, তাতেই চলতেন। কয়েকদিন ঠিকাদারীও করেছেন। চিংড়ির খামার করেছিলেন। কবিতা ছাড়া জীবনের আর সব নিয়ে ভীষণ খামখেয়ালী ছিলেন রুদ্র।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাসম্প্রদায়িক চেতনায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও যখন রুদ্র দেখলেন রাজনীতিবিদরা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠে খেলা জমে ওঠে। কবি ব্যথিত হন। ধর্মের ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়ার পাঁয়তারা হয়। তখন তিনি উচ্চারণ করেন...
‘কথা ছিলো ’আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’,
আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।
অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু
অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।
জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি,
আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন।’
(কথা ছিলো সুবিনয়)
রুদ্রের লেখা ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো, বাংলা গানে অসম্ভব জনপ্রিয় ও বিখ্যাত একটি গান। ‘অন্তর বাজাও’ নামে একটি গানের দল গড়েছিলেন রুদ্র। শেষ জীবনে রুদ্র ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের সঙ্গে আর পেরে উঠেননি তিনি।
দ্রোহী রুদ্রের ভেতরেই বসবাস করতো অসম্ভব রোমান্টিক এক সত্ত্বা। তাই তো রুদ্র ‘উল্টো ঘুড়ি’ কবিতায় লিখেছেন:-
এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!
বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা-
দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে
স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি,
কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত?
সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু-
না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি,
যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে
উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি।
(উল্টো ঘুড়ি)
আশির দশকে যে কজন কবি বাংলাদেশিদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি তাদের অন্যতম। ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবন ছিল তার। রুদ্রের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো ‘উপদ্রুত উপকূল’ (১৯৭৯), ‘ফিরে পাই স্বর্ণগ্রাম’ (১৯৮২), ‘মানুষের মানচিত্র’ (১৯৮৪), ‘ছোবল’ (১৯৮৬), ‘গল্প’ (১৯৮৭), ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ (১৯৮৮) ও মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)। এ ছাড়া ছোটগল্প ‘সোনালি শিশির’, বড়গল্প ‘মনুষ্য জীবন’ ও নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’ তিনি রচনা করেন। তিনি অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুন ২০১৭/রুহুল/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন