ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ফসল উৎপাদনের খরচ বাড়ছে

কাঞ্চন কুমার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফসল উৎপাদনের খরচ বাড়ছে

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অপরদিকে, অপরিকল্পিতভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি নির্মাণের কারণে কমছে আবাদি জমি।

খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় কম জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে হচ্ছে কৃষকদের। কম সময়ে বেশি ফসল পেতে রাসায়নিক সারের দিকে ঝুঁকছেন তারা। এতে কমছে মাটির উর্বরতা। বছরের পর বছর এমন চলতে থাকলে একসময় এসব জমিতে ফসল ফলবে না।

বাংলাদেশের যেসব জেলায় ধান, পাট, সবজিসহ অর্থকরী ফসল উৎপাদন বেশি হয় সেসবের মধ‌্যে কুষ্টিয়া জেলা অন্যতম। এ জেলার মাটি চাষের জন‌্য খুব উপযোগী ছিল একসময়। কিন্তু অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার, কীটনাশক প্রয়োগ, মাটিদূষণ, অধিক হারে তামাক চাষের ফলে ধীরে ধীরে মাটিতে কমে যাচ্ছে জৈব পদার্থের পরিমাণ, কমছে উর্বরতা।

ফসল উৎপাদনে জৈব সার ব্যবহার না করায় কৃষিজমি হারাচ্ছে উৎপাদনক্ষমতা। ফলে ফসল উৎপাদনে সার প্রয়োগ ও সেচ দিতে কৃষকদের বেশি টাকা খরচ হচ্ছে।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার শাহাপুর এলাকার ধানচাষি আব্দুল হালিম বলেন, জমির উর্বরতা শক্তি আগের মতো আর নেই। সারের জোরে ধান আবাদ করতে হয়। সার দিলে ধান হয়, না দিলে হয় না। পাঁচ/সাত বছর আগে যে জমিতে সার লাগত ২০ কেজি, এখন সেখানে লাগছে ৪০/৫০ কেজি।

তিনি বলেন, এবার আমি দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। ১ বস্তা ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি পটাশ সার দিয়েছি। ৩১০ টাকার আগাছানাশক এবং প্রায় ৪০০ টাকার কীটনাশক ব‌্যবহার করেছি। আগে এত সার লাগত না। এখন মাটির উর্বরতা কমায় সার বেশি লাগছে।

একই উপজেলার আমলা এলাকার চাষি আমিরুল ইসলাম বলেন, এবছর চার বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছি। গত মৌসুমে ছয় বিঘা জমিতে ধান ছিল। আগের মতো আর ধান পাওয়া যায় না। দামও নেই। সারের দাম দিতেই ধান বিক্রির টাকা শেষ। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ায় সার বেশি লাগছে। খরচও দ্বিগুণ হচ্ছে।

আমিরুল ইসলাম তার তিন ফসলি জমিতে দুই বার ধান আর এক বার তামাক চাষ করেন। তিনি তামাক সম্পর্কে বলেন, তামাকে ইদানিং লাভের চেয়ে খরচ বেশি। সার দিয়ে দিয়ে আমরা মাটি প্রায় নষ্ট করে ফেলেছি।

আশান নগর এলাকার মডেল সবজি চাষি মারুফ বলেন, মাটির শক্তি দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। আমরা মাটিতে গোবর সারও ঠিকমতো দিতে পারিনি। তাই এখন ২০ কেজির পরেবর্তে ৩০ কেজি সার লাগে। রাসনায়িক সারের কারণে সবজির স্বাদ আগের মতো হয় না।

আরেক চাষি সিহাব আলী বলেন, সবজি খেতে আগের চেয়ে সার বেশি লাগে। সারের দামও বেশি। তাই উৎপাদন খরচ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।

জেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা জমিতে জৈব সার ব্যবহার করতেই চান না। তারা তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার জন্য অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার দেন। এতে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিতে প্রয়োজন জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো। যে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি, সে জমির উর্বরতাও বেশি।

কুষ্টিয়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আফরোজা নাজনীন বলেন, বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার মাটিতে জৈব পদার্থ ১.৬১ ভাগ। আদর্শ মাটিতে ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। আমাদের জরিপ অনুযায়ী, ২০০৩ সালে কুষ্টিয়ার মাটিতে গড় জৈব পদার্থ ছিল ২.৭৫ ভাগ, ২০১৬ সালে ছিল ১.৯৭ ভাগ এবং ২০১৮ সালে ছিল ২.১ ভাগ। গত ১৫ বছরে জমিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি কমেছে ১.১৪ শতাংশ।

তিনি বলেন, ফসল বিন্যাস বেশি হওয়ায় জমিতে থাকা জৈব পদার্থ বেশি পরিমাণে ব্যবহার হয়। অন্যদিকে, কৃষক মাটিতে জৈব পদার্থ কম পরিমাণে প্রয়োগ করে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদনে পুষ্টি উপাদান বেশি প্রয়োজন হচ্ছে।

আফরোজা নাজনীন জানান, জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে থাকলে ফসল উৎপাদন কমে যাবে। কারণ, জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। এটি মাটির রস ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জৈব পদার্থ কমে গেলে অনুজীবের কার্যক্রম কমে যাবে। ফলে এই অনুজীব, যা রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য উপাদানকে ভেঙে উদ্ভিদের গ্রহণযোগ্য পুষ্টি উপাদান তৈরি করে, তা ব্যাহত হবে এবং মাটির উর্বরতা দিন দিন কমতে থাকবে।

কৃষি কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জৈব পদার্থের গুরুত্ব বোঝাতে এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈব পদার্থ ব্যবহারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার আহ্বান জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। ফসলের বেড়ে ওঠার জন্য যেসব পুষ্টি উপাদন প্রয়োজন তার অধিকাংশ উপাদান জৈব পদার্থের মধ্যে থাকে। বার বার ফসল উৎপাদনসহ নানা কারণে মাটি থেকে জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে। ফলে রাসায়নিক সারের পরিমাণ বেশি লাগছে। কৃষকরা মাটিতে প্রয়োজনমতো পুষ্টিসমৃদ্ধ জৈব সার দিচ্ছেন না। এছাড়া, তামাকে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। এমন চলতে থাকলে ফলস ফলাতে খরচ আরো বাড়বে। আমরা কৃষকদের এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করছি।

কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শ্যামল কুমার জানান, অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার মাটির উর্বরতা কমার কারণ। এমন হতে থাকলে মাটিতে ফসল ফলানো অধিক ব্যয়বহুল হবে। জৈব পদার্থ কমতে থাকলে একসময় জমি অনুর্বর হবে। আমরা বিভিন্ন কম্পোস্ট সার, জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি, যাতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং মানসম্মত ফসল পায়। তা না হলে ফসল উৎপাদনে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।


কুষ্টিয়া/কাঞ্চন কুমার/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়