ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ফিদেল কাস্ত্রো : বিংশ শতকের প্রতীক

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১৩ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিদেল কাস্ত্রো : বিংশ শতকের প্রতীক

রুহুল আমিন : ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ, যিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধু কাস্ত্রো নামেই পরিচিত। কিউবান রাজনৈতিক নেতা ও সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী।

ফিদেল ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ‍ওরিয়েন্তে প্রদেশে বিরান শহরের কাছে জন্মগ্রহণ করেন।মহান বিপ্লবীর জন্মদিনে অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ফিদেল কাস্ত্রোর জীবন ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়,  ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবার নাম অ্যাঞ্জেল কাস্ত্রো। বাবা ছিলেন চিনিকল মালিক।  মায়ের নাম লিনা রুজ গনজালেস। ভাই রাউল ও র‌্যামন ছাড়াও ফিদেল বড় হয়েছেন বোন অ্যাঞ্জেলা, এমা ও অগাস্টিনার সাহচর্যে।

ফিদেলের পড়াশোনা শুরু হয় প্রাইভেট জেসুইট বোর্ডিং স্কুলে। এরপর সান্তিয়াগোর ডলোরস কলেজ ও হাভানার বেলেন কলেজ পেরিয়ে কাস্ত্রো ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব হাভানার ল’ স্কুলে। স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে হিসেবে আইনজীবী হয়ে সহজ-সরল দিন কাটাতে পারতেন ফিদেল।কিন্তু ফিদেল বেছে নেন বন্ধুর পথ। হাভানার ল স্কুলে এসে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ওই সময়েই তার মনে কিউবান জাতীয়তাবোধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতের ছাপ পড়ে।

১৯৪৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকে তখনকার স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোকে উৎখাতে এক বিদ্রোহে অংশ নেন ফিদেল। তাতে ব্যর্থ হলেও দমে যাননি তিনি। পরের বছর চলে যান কলম্বিয়ার বোগোতায়। সেখানে তিনি সরকারবিরোধী দাঙ্গায় অংশ নেন।

একই বছর কাস্ত্রো যোগদেন সংস্কারপন্থি দল ‘পার্টি দো অর্তোদক্সোতে (অর্থোডক্স পার্টি)’। কমিউনিস্টবিরোধী ওই দলের প্রার্থী এদুয়ার্দো চিবা ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়।

এ সময় মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন ফিদেল; একইসঙ্গে কিউবান কংগ্রেস নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৫২ সালে মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন তিনি। এজন্য  ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। ১৯৫৩-র ২৬ জুলাই দ্য ‍মুভমেন্টের ১৫০ সদস্য কিউবার সান্তিয়াগোতে থাকা মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করে। ওই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে কাস্ত্রোকে বন্দি করা হয়। এরপর তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

জেলে থাকার সময় ফিদেল তার দলের নাম বদলে রাখেন ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই ‍মুভমেন্ট’। দুই বছর পর এক ‍চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল। সেখানেই দেখা হয় আর্জেন্টাইন চে গুয়েভারার সঙ্গে।

মেক্সিকোতেই ফিদেল, রাউল ও চে পরিকল্পনা করেন কিউবায় পুনরায় ফিরে গিয়ে বাতিস্তা সরকার উৎখাত করবেন। ১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর ফিদেল আর তার ৮১ জন সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকায় চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলের মানজানিলোতে নামার পরিকল্পনা করেন।

তাদের আসার খবর পেয়ে বাতিস্তা সেখানে বাহিনী পাঠায়। ফিদেলরা নামার সময় গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। চে আর রাউলসহ বাকিদের নিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন ফিদেল। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ শুরুর পর জনগণের সমর্থন নিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষ দিক থেকে ফিদেল বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে কিউবা দখলে নেয় ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই ‍মুভমেন্ট’।

ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থন নিয়ে ওই বছরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যানুয়েল উরুতিয়া, হোসে মিরো কর্দোনা হন প্রধানমন্ত্রী। ফিদেলকে দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব। পরের মাসেই মিরো পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেল। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কারখানা এবং খামারগুলোকে জাতীয়করণ করেন তিনি, করেন ভূমি সংস্কার। এই সময় ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং একইসঙ্গে কিউবায় বিদেশি কোম্পানির সম্পদ জাতীয়করণ করেন। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তেল কেনার চুক্তি করেন ফিদেল।

যুক্তরাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ওই তেল পরিশোধনে আপত্তি জানালে ফিদেল তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ক্ষমতা নেওয়ার পর ১৯৬১ সালই ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য সবচেয়ে সঙ্কটকালীন বছর। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে ছেদ টানে। ওই বছরের এপ্রিল ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাকে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেন। এ সময় সিআইয়ের প্রশিক্ষণে ওই বছরই কিউবা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১৪০০ দেশত্যাগী কিউবার ‘বে অফ পিগে’ ফিরে ফিদেলকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়।

১৯৬৫ সালে কাস্ত্রো কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নিজের দলকে একীভূত করেন, নিজে হন দলের প্রধান। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একনিষ্ঠ সমালোচক হিসেবে।

১৯৬৬ সালে কাস্ত্রো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে গড়ে তোলেন নানা সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পরের বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লাতিন আমেরিকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, যার হাত ধরে এর পরের কয়েক দশকে ওই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়।

১৯৭০ এর দশকে কাস্ত্রো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সোভিয়েত বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে সামরিক সহায়তাও পাঠান। তার পাঠানো সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনে।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে যোগ দেন কাস্ত্রো। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয় তার। দুই নেতাই একে অপরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় সামরিক আগ্রাসন না চালালেও ফিদেলকে হত্যা করতে একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যায়।কিউবার গোয়েন্দাদের দাবি, কেবল  কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য ৬৩৮টি চেষ্টা চালিয়েছে সিআইএ।

ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবাজুড়ে ১০ হাজার নতুন স্কুল খোলা হয়। শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া হয় পাহাড়ি, দুর্গম প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে। এর ফলও মেলে হাতেনাতে, অল্প সময়ের মধ্যে কিউবার স্বাক্ষরতার হার হয়ে দাঁড়ায় ৯৮ শতাংশ।

তবে কাস্ত্রোর সমালোচনাও কম নয়। পশ্চিমারা তাকে ‘অধিকার হত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। তার আমলে বন্ধ হয়েছে পেশাজীবী আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়নের ধর্মঘট করার অধিকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি গণমাধ্যম, বিপাকে পড়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়ন ও সেসব দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন এবং জোরপূর্বক দেশত্যাগ করানোরও অভিযোগ আছে ফিদেলের ‍বিরুদ্ধে।

১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়। ধস ঠেকাতে নতুন পন্থা নেন ফিদেল কাস্ত্রো। ডলারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সঙ্গে স্বল্প আকারে পর্যটনও চালু করেন ফিদেল। প্রায় চার দশক পর ১৯৯৬ সালে আবারো যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ফিদেল।

২০০১ সালে হারিকেন মিশেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কিউবায় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠাতে চাইলেও তা ফিরিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নগদ টাকায় খাদ্য কেনার প্রস্তাব দেন ফিদেল। এ সময় তিনি ১১৮টি কারখানা বন্ধের আদেশ দেন।

নব্বই দশকের শেষদিক থেকে কাস্ত্রো অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন। আর ২০০৬ সালের  ৩১ জুলাই আচমকা এক ঘোষণায় ছোটভাই ও সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা রাউলের হাতে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেন ফিদেল।

২০০৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কাস্ত্রো আনুষ্ঠানিকভাবে কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ২০০৮ সালে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর প্রকাশ্যে খুব একটা আসতেন না ফিদেল। অবসরে নিজের অভিজ্ঞতা ও মত পত্রিকায় প্রকাশ করতে ‘রিফ্লেকশন অব ফিদেল’ নামে কলাম লেখা শুরু করেন ফিদেল। ২০০৭ সালে তার আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়।

১৯৫৯ সালে ক্ষমতা দখলের পর কম লোকই ভেবেছিল ফিদেল কিছু করতে পারবেন।কিন্তু তিনি দেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ, হত্যার ষড়যন্ত্র পেরিয়ে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও।

২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি মারা যান। আদর্শ ভিন্ন হলেও মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোকে বিশ্বের অনেক নেতা বিংশ শতকের প্রতীক বলে অভিহিত করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়