ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, সীমান্তে টহল দ্বিগুণ

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ৪ মে ২০২১   আপডেট: ১৩:৩৫, ৪ মে ২০২১
ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, সীমান্তে টহল দ্বিগুণ

সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা

কক্সবাজারের সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে। এতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি কঠোর সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এর পাশাপাশি সীমান্তে বিজিবির টহল সংখ্যাও দ্বিগুণ করা হয়েছে।

গেল এক সপ্তাহে ৫০ জনের অধিক নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং ইউএনএইচসিআর। 

এদিকে, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল।

বিজিবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গেল ৪ মাসে মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় ১৪৭ জন রোহিঙ্গা। তাদের বিজিবির কক্সবাজার ও টেকনাফ ব্যাটালিয়ন সীমান্তে প্রতিহত করে স্বদেশে ফেরত পাঠায়। ফেরত পাঠানোর মধ্যে পুরুষ ১০৫ জন, নারী ২৮ জন ও শিশু ১৪টি। গেল ৪ মাসের মধ্যে এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। যার সংখ্যা ছিল ৬২ জন।

বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে কক্সবাজার ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মোট ১৬ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। তারমধ্যে টেকনাফে ৭ জন ও কক্সবাজারে ৯ জন। পরে সীমান্তের স্ব-স্ব পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। 

ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মোট ১৩ জন অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। তার মধ্যে টেকনাফে ১০ জন ও কক্সবাজারে ০৩ জন। পরে সীমান্তের স্ব-স্ব পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

মার্চ মাসে কক্সবাজার ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ৫৬ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। তারমধ্যে টেকনাফে ৪৮ জন ও কক্সবাজারে ০৮ জন। পরে সীমান্তের স্ব-স্ব পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

এপ্রিল মাসে কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না করলেও টেকনাফ ব্যাটালিয়নের সীমান্ত দিয়ে ৬২ জন অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। যার মধ্যে ৫২ জন পুরুষ, ৫ জন নারী ও ৫টি শিশু। পরে সীমান্তের স্ব-স্ব পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

বিজিবি হেডকোয়ার্টার পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন,  ‘মিয়ানমারের নাগরিকদের সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে সেটা দেখতে পাচ্ছি। সেই প্রেক্ষিতে সীমান্তে বিজিবির টহল সংখ্যাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টাও যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি তাদের প্রতিহত করার প্রচেষ্টাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাই হচ্ছে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি; যা পুরোপুরি বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিজিবি প্রতিনিয়তই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রতিহত করে স্বদেশে পাঠিয়েছে।’ 

লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফয়জুর রহমান আরও বলেন, ‘কক্সবাজার ও টেকনাফ সীমান্তের ব্যাপকতা, ভূমির গঠন-ধরন সবকিছু সবার জানা। এত ব্যাপক সীমান্তে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি আমাদের এখনও হয়নি। তবে বিজিবির দৃশ্যমান, সম্ভাব্য যেসব পয়েন্টগুলো, দুর্বল এলাকাগুলোতে টহল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও সার্ভিলেন্স সিস্টেম, হাই-স্পিড ইঞ্জিন বোট, নদীতে রাতের বেলায় টহলের মধ্যে মিয়ানমারের নাগরিকদের অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে প্রতিহত করে স্ব-স্ব পয়েন্ট ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গেল কয়েক সপ্তাহে প্রতিহত করার সংখ্যাটা দেখলে বুঝা যাবে, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির সতর্ক অবস্থান।’ 

এদিকে, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, গেল এক সপ্তাহে ১৬ এপিবিএনের দায়িত্বে থাকা টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে নতুন করে ২২ জন রোহিঙ্গা এসেছেন। তারা ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমারের জেল হাজতে ছিল। সর্বশেষ রোববার (০২ মে) মিয়ানমারের মংডুর ওয়াবেক গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ আহাম্মদ (৭৫), সালেহ আহাম্মদ (৭২) ও বড় গর্জের বিলের বাসিন্দা মো. রহমত উল্লাহ (৩৫) বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয়। খবর পেয়ে এপিবিএন সদস্যরা তাদের হেফাজতে নিয়েছে। আর বিষয়টি অত্র ক্যাম্পের সিআইসিকে অবহিত করা হয়েছে। 

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, গেল ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহিংসতা চলাকালে তারা ৩ জন সেখানে গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে ছিলো। কিছুদিন পূর্বে তারা জেল হতে মুক্তি পেয়ে রোববার (০২ মে) সকাল ১০টায় বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের শালবাগান ক্যাম্পে আগে থেকে বসবাসরত তাদের পরিবারের কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছে। 

১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘শুধু ১৬ এপিবিএন আওতাধীন ক্যাম্প নয়; এখানে আরও দুটি এপিবিএন রয়েছে, তাদের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও জানিয়েছেন, তাদের ক্যাম্পেও কিছু সংখ্যক নতুন রোহিঙ্গা এসেছেন। সব মিলিয়ে ৫০ জনের বেশি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে।’ 

কথা হয় গত ২৯ এপ্রিল টেকনাফে শালবাগান ক্যাম্পে আসা মিয়ানমারের মংডুর বড় গর্জের বিল এলাকার সোনা আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে ৪ বছর ৫ মাস ৫ দিন কারাগারে ছিলাম। এরপর চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল মিয়ানমার সরকার জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে। এরপর গত ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে এসেছি। প্রথমে মিয়ানমারের মংডু থেকে শীলখালী, তারপর উনচিপ্রাং হয়ে সাঁতার কেটে বাংলাদেশে চলে আসি। এরপর শালবাগান ক্যাম্পে আসি। এখন শালবাগান ক্যাম্পে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে আছি।’ 

নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল।

কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের বন্দি অনেক রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে। তারা এখন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে যে রোহিঙ্গাগুলো মিয়ানমারের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেছে তাদের মিয়ানমারেরই থাকার কথা। কিন্তু তারা অনুপ্রবেশ করে এখন বাংলাদেশে ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় পাচ্ছে। এভাবে নতুন করে রোহিঙ্গারা যদি বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় পায়; তাহলে মিয়ানমারে থাকা অন্যান্য রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে উৎসাহিত হবে।

ফরহাদ ইকবাল আরও বলেন, ‘সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানাব; সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে নতুন করে মিয়ানমারের নাগরিক একজন রোহিঙ্গাও যাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে।’ 

সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক সরকার ১৩৭ জন বিদেশিসহ মোট ২৩ হাজার ৪৭ বন্দিকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি দিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে ৬ শতাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে; যারা ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট সহিংসতার আগে ও পরে আটক হয়েছিল।
 

/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়