ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বই বিক্রেতা থেকে ইতিহাস গবেষক

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বই বিক্রেতা থেকে ইতিহাস গবেষক

অজয় কুমার রায়

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে যে ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করতেন, কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান হয়ে অফিসে-বাসা বাড়িতে পৌঁছে দিতেন চিঠি-পত্র-মালামাল, আজ সেই ছেলেটির লেখা বই বিক্রি হচ্ছে নামি-দামি বইয়ের দোকানে, একুশে বই মেলায়। লেখক হিসেবে পাঠকের কাছে নিজের জায়গা তৈরি করে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে।

পুরো নাম অজয় কুমার রায়। পিতা ললিন বর্মন। জন্মেছেন ১৯৮৫ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত দেওনাপাড়া গ্রামে। দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে তিনি সবার বড়। বাবা দিনমজুর। বংশে কারো পড়াশুনার বালাই নেই। কিন্তু ছোটবেলা থেকে তার পড়ালেখার প্রতি ছিল দারুন আগ্রহ।

পড়ালেখা শুরু করেন কোষাবিল পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হাইস্কুল ছিল সালাউদ্দিন দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। অভাব অনটনে কেটেছে অজয়ের শৈশব-কৈশোর। পড়ালেখার সরঞ্জাম কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিলনা তার পরিবারের। পড়ার খরচ তাকে চালাতে হতো মজুরিভিত্তিক অন্যের জমিতে কাজ করে। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন পাড়ার ছেলেদের টিউশনি পড়ানো শুরু করেন। হাইস্কুলে পড়াকালীন কবিতা লেখার আগ্রহ মাথায় চেপে বসে অজয়ের। ওই সময় থেকেই তার মগজে ঘুরতে থাকে কবি ও লেখক হওয়ার স্বপ্ন।

২০০৩ এস.এস.সি পাশ করার পর ভর্তি হন পীরগঞ্জ ডিএন কলেজে। লেখালেখি ও ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এইচ.এস.সিতে রেজাল্ট খারাপ হয়। পরিবার বললেন অনেক হয়েছে, বেশি পড়ে কি হবে, গরীবের ঘোড়া রোগ হতে নেই বরং সংসার করে সুখী হোক। অজয়কে বিয়ে করিয়ে দিলেন।

কিন্তু বিয়ের পর দারিদ্রতা আরো জোরে চেপে বসে। বউয়ের ভরণ-পোষণ, তিন বেলা আহার, পোশাকের সংস্থান হয়না ঠিকমতো। তার ওপর ধার-দেনার বোঝায় চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন অজয়। অভাব থেকে পালিয়ে বাঁচতে, জীবন জীবিকার তাগিদে কাউকে না জানিয়ে ২০০৯ সালে চলে আসেন ঢাকায়। সামান্য বেতনে চাকরি নেন একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান হিসাবে।

তবে এই জীবন সংগ্রামের মধ্যেও তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তিনি বড় লেখক হবেন এবং ঘুরে দাঁড়াবেন। কাজে ফাঁকে সুযোগ পেলেই বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে কবিতা প্রকাশের জন্য ধরনা দিতেন। তবে কেউ তেমন পাত্তা দিতো না। ২০১০ সালে লেখালেখির পরিচিতির কারণে একটি প্রকাশনা সংস্থায় বিক্রয় কর্মীর চাকরি নেন। প্রকাশনীতে চাকরির কারণে অনেক বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন এবং পড়ার সুযোগও পান। ২০১১ সালে যুক্ত হন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে। এতে করে অজয়ের লেখক হওয়ার স্বপ্ন একধাপ এগিয়ে যায়।

দীর্ঘ বিরতির পর ২০১১ সালে আবার শুরু করেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা, বর্তমানে তিনি স্মাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।

নিজের সম্পাদনায় বের করেন ত্রৈমাসিক শিল্প-সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘টাঙ্গন’। কবিতা, গল্প, গবেষণা ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কলাম ও ফিচার লেখেন নিয়মিত। লেখালেখির কারণে কবি মহাদেব সাহা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী ও কথা সাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের সানিন্দ্য পান ও সারা দেশের তরুণ লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়।

২০১৪ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয় অজয়ের লেখা প্রথম কবিতার বই ‘পাশা ও দেহবাস’। ২০১৫ সালে বই মেলায় প্রকাশ পায় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কতটা ভালোবাসলে ভালোবাসা কয়’।

তবে বইয়ের দুনিয়ায় তিনি দেখলেন অধিকাংশ জেলার ইতিহাস ও গুণী মানুষদের নিয়ে অনেক বই থাকলেও, নিজের জেলা ঠাকুরগাঁও নিয়ে তেমন বই খুঁজে পাননি। তখন থেকে মাথায় চিন্তা এলো ঠাকুরগাঁও এর ইতিহাস নিয়ে একটা বই করলে কেমন হয়।

তিনি ছুটতে থাকেন ঠাকুরগাঁও এর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে, বয়সী ও গুণী মানুষদের কাছে। কম বয়স হওয়ায় প্রথম দিকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। দীর্ঘ চার বছর মানুষের ধারে ধারে ঘুরে, তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন পক্ষের বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। তিনি প্রায় হতাশ হতেন, তবু হাল ছাড়েননি। নিজের স্বপ্ন থেকে পিছু হঠেননি এক-পাও।

অবশেষে ২০১৭ বই মেলাকে সামনে রেখে গণপ্রকাশন থেকে প্রকাশ পেয়েছে অজয় কুমার রায়ের লেখা ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাসভিত্তিক গবেষণাধর্মী বই ‘ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস’। ৩২০ পৃষ্টার বইটিতে ঠাকুরগাঁও জেলার প্রাচীন ইতিহাস, রাজনৈতিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ইতিহাস, লোকখাদ্য, পুরাকীর্তি, বিভিন্ন স্থাপনা, জেলার গুণীজনদের পরিচয়সহ জেলার নানান দিক ফুটে উঠেছে। বইটি পাওয়া যাবে একুশে বই মেলার ১২৭ নম্বর স্টলে।

লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে অজয় কুমার রায় বলেন, আমাদের দেশে পেশাদার লেখকের খুব সংকট। একজন পেশাদার লেখক হিসেবে বাকি জীবন কাটাতে চাই।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়