ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর রসবোধ

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৭ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধুর রসবোধ

রবীন্দ্রসান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন তাঁদের স্মৃতিকথার পাতায় পাতায় লেখা আছে- ব্যক্তিজীবনে কবি কতটা সুরসিক ছিলেন। তিনি ভৃত্যদের সঙ্গেও হাস্যকৌতুক করতেন। একবার নিজেই বলেছেন, ‘ঠাট্টা না করতে পেলে আমার চলে না সে চাকর দিয়ে। প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।’

এ যে কত বড় সত্য, নিকটজনেরাই শুধু উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কাছাকাছি যারা থাকতেন কবিগুরু প্রায়ই তাদের নতুন নামকরণ করতেন। পার্সোনেল সেক্রেটারি, এমনকি অ্যাটেন্ডেন্টদেরও রসিকতা করে ডাকনাম দিতেন। ‘বলডুইন’, ‘সুধাসমুদ্র’, ‘আলু’ এই ছিল নামের বাহার।

সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর মাথায় বিরাট টাক দেখে কখনও ডাকতেন ‘বলডুইন’, কখনও ‘সুধাসমুদ্র’ আবার মাড়োয়ারীদের কাছ থেকে শান্তিনিকেতনের অর্থসংগ্রহ করার জন্য কখনও ডাকতেন ‘সুধোরিয়া’। সচ্চিদানন্দ রায়কে বলতেন ‘আলু’।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও নাম নিয়ে রসিকতা করার ঝোঁক ছিল। আফ্‌জালুল হককে ডাকতেন ‘ডাবজল’, মোতাহারকে ‘মোতিহার’, হায়দারকে ‘হাইদর’, সজনীকান্ত দাসকে বলতেন ‘সজনে ঘণ্ট খাস’, আকরাম খাঁকে ‘বাগরম খাঁ’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এখানে তাঁর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই।

শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানও যে ঘনিষ্ঠজনদের রসিকতা করে নাম রাখতেন সে তথ্য পাই সাংবাদিক এবিএম মূসার কল্যাণে। মূসা জানাচ্ছেন, তাঁদেরই তিন সাংবাদিক বন্ধুকে বঙ্গবন্ধু নাম দিয়েছিলেন আপদ, বিপদ ও মুসিবত। ফয়েজ আহমদকে তিনি ডাকতেন ‘আপদ’, মূসাকে ‘বিপদ’ এবং আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে ডাকতেন ‘মুসিবত’ নামে!

শুধু তাই নয়, ফেনীর তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মী রুহুল আমিনকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি তার নাম দিয়েছিলেন ভুসি! কারণ তিনি ভুসির ব্যবসা করতেন।

রুহুল আমিন সুযোগ পেলেই এবিএম মূসার নিকট তার অপ্রাপ্তির কথা শুনিয়ে আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমার কিছু হলো না, দেশ ও দলের জন্য এত কিছু করেছি, সর্বস্বান্ত হয়েছি। মুজিব ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন অথচ আমি কিছুই পেলাম না।’

রুহুল আমিনের ঘ্যানঘ্যানে বিরক্ত হয়ে মূসা একবার তাকে নিয়ে এলেন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ‘ওরে আমার ভুসি এসেছে’ বলে হইচই করে উঠলেন। রুহুল আমিন কিন্তু যে কথাগুলো বলার জন্য এসেছিলেন, ভুলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে যতই বলেন, ‘কেমন আছিস, কোনো অসুবিধা নেই তো?’ রুহুল আমিন ততই তোতলান আর বলেন, ‘ভা-ভা ভালোই আছি। ক-ক কোনো অসুবিধা নাই।’

এভাবেই প্রায় ত্রিশ মিনিট কথোপকথন চলল। কিন্তু রুহুল আমিন মুখ ফুটে কিছুই চাইতে পারলেন না। ফেরার পথে মূসা যখন খোটা দিয়ে বললেন, ‘কী হলো এত প্যানপ্যানানি গেল কই? কিছুই তো চাইতে পারলে না!’

রুহুল আমিন আমতা আমতা করে বললেন, ‘কী করব, নেতাকে দেখে যে সবই ভুলে গেলাম!’

এমনই ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব। মুহূর্তেই তিনি সবাইকে বুকে টেনে নিতে পারতেন। সমুদ্রসম গভীর হৃদয়ে শত্রুর জন্যও তিনি ভালোবাসা জমিয়ে রাখতেন। এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে, পরাধীন দেশে যারা তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বলেছেন, লিখেছেন, চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন, স্বাধীনতার পর তাদের বিপদ বুঝতে পেরে নির্ভরতার ছায়া হয়ে তাদেরই পাশে দাঁড়িয়েছেন। আগলে রেখে প্রাণখোলা পরম হাসিতে শুনিয়েছেন অভয়-বাণী।

না, কবি নজরুলের মতো ছন্দহিল্লোলে চারদিক মাতিয়ে, প্রাণ কাঁপিয়ে, বাতাসে তুফান ছুটিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়তো হঠাৎ হো হো শব্দে হেসে উঠতেন না। কবিগুরুর মতো ঐশ্বর্যের সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতাও নয়, বঙ্গবন্ধুর হাসি অক্লাক্ত, নির্ভার, নিঃশঙ্ক।

কর্মীদের সহচার্যে তিনি স্বজন-সান্নিধ্য অনুভব করতেন। বিষয়টি অনুধাবন করে চীন থেকে ফেরার পর ১৯৫৩ সালে মওলানা ভাসানী একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী মুসলীম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। অর্পিত দায়িত্ব পালনে বঙ্গবন্ধু কখনও কোনো কালেই শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। দায়িত্বের প্রতি তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান। যে কারণে পরবর্তীকালে মওলানা দল ছেড়ে গেলেও আক্ষেপ করে বলেছেন, শেখ মুজিবের মতো সেক্রেটারি তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে একজনকেও পাননি।

অসম্ভব প্রখর ছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি। তিনি পার্টির অন্যান্য নেতা-কর্মীদের তো বটেই, সহকর্মীদের ঘরের খবরও যথাসম্ভব রাখতেন। এর প্রমাণও বিভিন্ন সময় পাওয়া যেত।

স্বাধীনতার পরের বছর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠান শেষে তিনি ১৪ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী প্রত্যেকের হাতে উপহারস্বরূপ একটি করে ভারতীয় বেঙ্গালুরু সিল্কের শাড়ি দিলেন। বলাবাহুল্য, শাড়িগুলো মন্ত্রীদের বেগম সাহেবাদের জন্য। শাড়ি বিতরণ শেষ, মন্ত্রীরা ইন্দিরা গান্ধীকে সমবেতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। এমন সময় দূর থেকে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরের শাড়িখানি প্রায় ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।

এ ঘটনায় ইন্দিরা গান্ধী অবাক হতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মনোরঞ্জন ধর ব্যাচেলর মানুষ। তাঁর শাড়ির দরকার নেই। বেচারা জহুরের দুই বউ। এক শাড়ি নিয়ে দুজনে টানাটানি করবে। তাই তারটি জহুরের আরেকটি বউয়ের জন্য দিলাম।’

কর্মে একাগ্রতা, লক্ষ্যে অবিচল, ভয়-ডরহীন মনোভাব, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং অবশ্যই কর্মীদের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নেতার চেয়ে কর্মীদের বন্ধু হতেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসিতে কখনও কেটে যেত মনের ঈশান কোণে জমে থাকা অভিমানের মেঘ, কখনও ঝরত স্নেহসুধা। এমন অনেকবার  হয়েছে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত হাসির ঝিলিকে মিলেছে প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত, আবার কখনও ধরা পরেছে সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ। যা তার রসিক মনের পরিচয়বাহী।

জাকারিয়া খান চৌধুরী ওরফে জ্যাক ছিলেন এবিএম মূসার বন্ধু। বিলেত থেকে স্বাধীন দেশে ফেরার পর তিনি বন্ধুকে ধরলেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। মূসা তাঁকে ‘মর্নিং নিউজ’-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োগ দিলেন। একদিন সন্ধ্যায় দুই বন্ধু মিলে গেলেন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।

জ্যাক পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এটাকে আবার কে নিয়ে এলো?’

উল্লেখ্য পারিবারিকভাবেই বঙ্গবন্ধু জ্যাককে চিনতেন। তারপরও মূসা বিস্তারিত শুনিয়ে বললেন, ‘ওকে আমার কাগজে নিয়েছি।’

‘তা ওর কী কাজ?’ বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন।

মূসা বললেন, ‘সম্পাদকীয় আর বিভিন্ন বিষয়ের ওপর উপসম্পাদকীয় লিখবে।’

‘বেশ ভালো।’ বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে বললেন, ‘যা লেখাবার ওকে দিয়ে সন্ধ্যার আগে লেখাবি। খবরদার সন্ধ্যার পর যেন কিছু না লেখে।’

কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন। শুধু জ্যাকের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কারণ সন্ধ্যার পর বিশেষ পানীয় পান শেষে তার বেহাল পরিস্থিতির কথা বঙ্গবন্ধু জানতেন। এজন্যই এই ইঙ্গিত।

আরেকবার গণভবনে সান্ধ্য আসর বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে উপস্থিত। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘নেতা, গাফ্‌ফার আমার সম্পর্কে কী লিখেছে দেখেছেন? লিখেছে, আমি নাকি সরাইলের কুকুর।’

বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন ঘটনা কী? জানা গেল আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তখন ‘দৈনিক জনপদ’-এর সম্পাদক। তাহের ঠাকুর সেই পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেয়ায় গাফ্‌ফার চৌধুরী তথ্য মন্ত্রণালয়ের কড়া সমালোচনা করে প্রতিমন্ত্রীকে ‘সরাইলের সারমেয়’ লিখেছে। প্রতিমন্ত্রী তাহের ঠাকুরের আদি বাড়ি সরাইল। ফলে তার সম্মানে ঘা লেগেছে।

নালিশ শুনে বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর গাফ্‌ফার চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বললেন, ‘অন্যায় করেছ! তাহেরকে সরাইলের কুকুর বলা ঠিক হয়নি। জানো কত প্রজাতির কুকুর আছে?’

এরপর তিনি নিজেই সেই ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন- ‘বিলেতি মেম সাহেবরা কোলে বসিয়ে ল্যাপডগকে আদর করে। অস্ট্রেলিয়ায় রাখালেরা ভেড়ার পাল সামলায় শেফার্ড কুকুর লেলিয়ে দিয়ে। ইউরোপে অ্যালসেসিয়ান কুকুর বাড়ি পাহারা দেয়। দুর্ধর্ষ এসব অ্যালসেসিয়ান অনেকটা সরাইলের কুকুরের মতো দেখতে, পাতলা লম্বা ভয়ঙ্কর-দর্শন।’

বঙ্গবন্ধু একটু থেমে গাফ্‌ফার চৌধুরীকে বললেন, ‘আমার ভজহরির মতো এমন ঘাড়ে-গর্দানে নাদুসনুদুস ফর্সা, তবে হ্যাঁ, রাগলে লালমুখো হয়ে যায়, এক ধরনের কুকুরও আছে বৈকি। সেগুলো হলো বুলডগ, লালমুখো, মোটাতাজা শরীর।’

এরপর তিনি আড়চোখে সুদর্শন, নাদুসনুদুস তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা গলায় বললেন, ‘গাফ্‌ফার, খবরদার এরপর কারো চেহারাসুরত নিয়ে ঠাট্টা করবা না।’

কথা শুনে উপস্থিত সবাই মাথা নিচু করে হাসি সামলানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাথা তোলার পর সেখানে আর লালমুখো ঠাকুরমশাইকে দেখা গেল না। তিনি ততক্ষণে পালিয়ে বেঁচেছেন।

পাঠক, লক্ষ করুন, বঙ্গবন্ধু তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে এখানে ‘ভজহরি’ বলছেন। খোলা মনের মানুষ না হলে নিকটজনকে নিয়ে এমন রসিকতা সম্ভব নয়।

বাগ্মিতা দক্ষ রাজনীতিকের অন্যতম গুণ। আব্রাহাম লিঙ্কন, চার্চিল থেকে শুরু করে বারাক ওবামা এমনকি ভারতে নরেন্দ্র মোদির বাগ্মী হিসেবে পরিচয় আছে। বলা হয়ে থাকে, নির্বাচনের আগে শুধু কথার জাদুতেই মোদি ভোটারদের ভুলিয়েছেন। সে তুলনায় সোনীয়া গান্ধী কিংবা রাহুল অনেকটাই নিষ্প্রভ। জাতীয় রাজনীতিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতা শুনবেন- এমন বক্তা বিরল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই অসামান্য গুণের অধিকারী ছিলেন। তুখোড় বক্তা হিসেবেই নয়, দ্বি-পাক্ষিক আলোচনাতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার! প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনে তিনি যেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি রসিকতা করতেও ছাড়েননি। 

১৯৬৯-এর উত্তাল সময়। আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠক বয়কট করলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধু বৈঠকে যোগ দিতে প্রস্তুত। উত্তপ্ত রাজনীতির সূক্ষ্ম মারপ্যাচে কে এগিয়ে কে পিছিয়ে শুরু হয়ে গেছে তার হিসাবনিকাষ।

মওলানা বললেন, ‘মুজিবর মিয়া, তুমি আরটিসিতে (গোল টেবিল বৈঠক) যাইও না।’

মুজিব সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, ‘হুজুর আমি তো কথা দিছি। মামলা উঠাইয়া নিলে রাওয়ালপিণ্ডি যামু।’

‘ভুট্টো যাইব না। আমিও বয়কট করছি।’ মওলানা এবার বুঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘তুমি না গেলেই আরটিসি শ্যাষ।’

‘তবুও ওয়াদা রাখতে দোষ কি?’ মুজিব বললেন।

‘মুজিবর মিয়া, রাওয়ালপিণ্ডি যাইয়া তুমি আরটিসি ভাঙবা ক্যামনে?’

‘আমি ছয় দফার সবকিছু- দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন দুই হাতে জাবড়াইয়া রাখুম। হুজুর, তাহলেই তো গোল টেবিল শ্যাষ!’

‘আর পিণ্ডি যাইয়া লাভ আছে?’ মওলানা শেষ যুক্তি শোনালেন, ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তো এখন মরা লাশ!’

মুচকি হেসে মুজিব পাল্টা যুক্তি দিলেন- ‘হুজুর, হেই মরা লাশের জানাজা পড়তে দোষটা কি?’

এই হলো বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক রসবোধ। বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর দোয়া নিয়েই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। এবং ছয় দফা দাবি থেকে এক চুলও সরে আসেননি। ফলে বৈঠক এমনিতেই ভেস্তে গিয়েছিল। মাঝখান থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর ওয়াদা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এ দেশের নিসর্গের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল আজন্ম অনুরাগ। মানুষের মতোই দেশের মাঠ-ঘাট, বনানীর প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ব। তিনি কতদিন মধুমতীর জলে নৌকা ভাসিয়েছেন, রাজনীতির প্রয়োজনে ছুটে গেছেন দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বিরামহীন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘পানির দেশের মানুষ আমি নৌকায় ঘুমাতে কষ্ট হয় না।’

কিন্তু সেবার কষ্ট পেয়েছিলেন মাঝি। ঘটনা হলো বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী আলতাফ হোসেনকে নিয়ে মওলানা শামসুল হক সাহেবের বাড়ি যাচ্ছেন। জরুরি প্রয়োজন, রাতেই নৌকায় রওনা হয়েছেন। মধুমতীর ওপর দিয়ে ছোট্ট নৌকা ভেসে চলেছে। অধিক ক্লান্তিতে বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছেন।

গভীর রাত। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নদীর এক জায়গায় বেশ চওড়া। সেখানে প্রায়ই ডাকাতি হয়। নৌকা সেখানে আসামাত্র একটা ছিপ নৌকা এগিয়ে এলো। একজন আগুন আছে কি না জানতে চাইল। আগুন চেয়েই ডাকাতেরা নৌকার কাছে আসে। এটা তাদের কৌশল।

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘নৌকা যাবে কোথায়?’ মাঝি বলল, ‘টুঙ্গিপাড়া’।  

নৌকা একদম নিকটে চলে এসেছে। এমন সময় আবারও প্রশ্ন, ‘নৌকায় কে?’ মাঝি তখন বঙ্গবন্ধুর নাম বলতেই ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে আঘাত করে বলল, ‘শালা আগে বলতে পারো নাই শেখ সাহেব নৌকায়।’ বলেই তারা দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে নিল।

ওদিকে শব্দ পেয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘুম ভেঙে গেছে। কাজী সাহেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম। না হলে উপায় ছিল না।’

বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, ‘বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।’

বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে কাজী সাহেবও সেই হাসিতে শামিল হলেন। মধ্য রাতের নীরবতা ভেঙে স্রোতস্বিনীর কুলকুল ধ্বনি সেই হাসির নিচে চাপা পড়ে গেল।     

 

তথ্যঋণ:
অসমাপ্ত আত্মজীবনী: শেখ মুজিবুর রহমান
মহাপুরুষ: এম আর আখতার মুকুল
মুজিব ভাই: এবিএম মূসা 


 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়