ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতায় অনন্য নজরুল॥ আহমদ রফিক

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতায় অনন্য নজরুল॥ আহমদ রফিক

তিরিশের (১৯৩০) দশকের শেষ দিক থেকে চল্লিশের দশকের অবিভক্ত বঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক টালমাটাল সময়, তার তীব্র ঝাঁজালো বারুদ গন্ধের দিনগুলো তারুণ্যের চেতনা আলোড়িত করেছিল। ঘটনার পর ঘটনা যেন রণপা’য় চড়ে চরম এক সম্ভাবনার দিক নির্দেশ করতে থাকে। সে হিসেবে তিরিশের দশকও কম তেজি নয় বিপ্লবে-বিদ্রোহে, আত্মদানে। যতীন দাস থেকে সূর্যসেন। বিপ্লবের রক্তঝরা হাঁকে বাংলাদেশসহ গোটা ভারত অগ্নিগর্ভ। কম নয় সেখানে বঙ্গদেশ তথা যুক্ত বাংলার ভূমিকা।

এ প্রসঙ্গে অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গের দুই অগ্নিপুরুষ বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম এবং বিপ্লবী ঘরাণার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু। কারাগার তাঁর অনিবার্য আবাসস্থল, অন্যথায় স্বগৃহে অন্তরীণ দুজনেই ইংরেজ শাসকের চোখে ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব। একজনের কবিতার বই একের পর এক সরকারি হুকুমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, অন্যজনকে কারণে-অকারণে পাঠানো হচ্ছে কারাগারে বন্দীদশায়।

এরা দুজন নিজ নিজ কর্মের ধারায় উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। নজরুলের আগুনমাখা কবিতা ও গান বিপ্লবী তারুণ্যের যৌবন তৎপর করেছে, আত্মদানে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই বিদ্রোহী কবির পরিচিতি সত্ত্বেও কাজী নজরুল ইসলাম প্রধানত এবং প্রকৃতপক্ষে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লববাদী কবি। তাঁর জীবনের অগ্নিঝরা সময়টা কেটেছে বিদেশি শাসকের নির্মমতায় ও দমননীতির মধ্যে।

নজরুলের সৌভাগ্য যে ১৯৪৭-এর আপসবাদী স্বাধীনতা তথা ক্ষমতার হস্তান্তর তাঁকে দেখতে হয়নি। ওই ঘটনার বেশ কয়েক বছর আগে ১৯৪২ সাল থেকে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, বাকহীন-সংবেদনহীন অবস্থায়। শুধু দুচোখে দেখে গেছেন দুঃসহ যত ঘটনা। সে দৃষ্টিতে তার স্বভাব-সুলভ অগ্নিঝরা প্রতিক্রিয়ার কোনো আভাস ধরা পড়েনি। প্রতিবাদ বা সংগ্রাম তো দূরের কথা। বলতে হয় এক করুণ ট্রাজিক দৃশ্যচিত্র!

এর এক বছর আগে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন চোখে নিয়ে বিশ্বযুদ্ধে রক্তাক্ত আবহে ছদ্মবেশে সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান। কাবুল থেকে রুশ সহায়তার নিশ্চয়তা না পেয়ে জার্মানি হয়ে শেষ পর্যন্ত জাপানে। তাঁর জন্য তৈরি হয় রাজনৈতিক সংকট স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে। এর কারণ অদ্ভূত যুদ্ধজোট মিত্রশক্তি বনাম আক্রমণকারী অক্ষশক্তির প্রবল দ্বন্দ্বে সুভাষ পরিস্থিতির শিকার।

তবু তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ (স্বাধীন ভারতীয় সৈন্য দল) গঠন, সেই সূত্রে নেতাজী সুভাষ হয়ে ওঠা, সেই সেনাদলের জাতিধর্ম নির্বিশেষে (হিন্দু-মুসলমান-শিখ নির্বিশেষে) স্বদেশ প্রেম, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আত্মদানের স্পৃহা, জাপানি সামরিক সহায়তায় আসামের মণিপুর পর্যন্ত পৌঁছে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ট্রাজিক অধ্যায় এ আলোচনার বিষয় নয়। তবে এ সংগ্রামের আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, বিশেষ করে এর সেকুলার চরিত্রের সঙ্গে নজরুলীয় সংগ্রামী আদর্শের প্রভূত মিল।

মিল রয়েছে ব্যর্থতায়ও। নজরুলের ক্ষেত্রে যা জৈবনিক ও দুর্ভাগ্যতাড়িত নিশ্চলতায়, সুভাষের ক্ষেত্রে তা রাজনৈতিক সংঘাতের নিয়তিতাড়িত ঘটনার টানে ট্রাজিক পরিণতিতে শেষ। নজরুলের সংগ্রামী ভূমিকা সম্পর্কে বিপ্লবী সুভাষের একটি কথা চিরায়ত চরিত্র অর্জন করেছে: ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব, তখন নজরুলের গান গাইব, যখন কারাগারে যাব তখনও তার গান গাইব’।

দুই
সুভাষের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রতিপন্ন করে, তাৎক্ষণিকতার অপবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বাঙালি জাতিসত্তার স্বাধীকার লড়াইয়ে তথা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তরুণ সংগ্রামী ও যোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে নজরুলের স্বাদেশিকতার চড়া সুরের লড়াকু গান, অবশ্য তেমনিভাবে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান, জীবনানন্দের রূপসী বাংলার আকর্ষণীয় চিত্রকল্পে উদ্দীপ্ত হয়েছে যুব সমাজ নানা মাত্রায়। পরিণামে বিজয়।

নজরুলের লড়াকু কবিতা, বিপ্লবী চরিত্রের কবিতা ও গান এভাবে মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে উঠেছে সংগ্রামীদের জন্য, বিশেষভাবে তরুণদের জন্যে। এবং তা কালান্তরে চিরঞ্জীব মর্যাদা অর্জন করেছে যেকোনো সংগ্রামী তরুণের চেতনা উদ্দীপ্ত করতে। এ আহ্বান বৃথা যাবার নয়:

‘কারার ঐ লোহ কপাট

ভেঙ্গে ফেল্‌ কর্‌রে লোপাট

                       রক্তজমাট

শিকলপূজার পাষণ-বেদী’ ইত্যাদি

বাক্যগুলি শাব্দিক প্রতীকে সর্বকালের সংগ্রামী প্রেরণা। এসব গান বা কবিতার ‘প্রলয় দোলা’ মানুষের সংগ্রামী চেতনা উজ্জীবিত করতে অভাবিত সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪২-এ বিদেশী শাসক তাড়ানোর সংগ্রামে বিদ্রোহীদের ঔপনিবেশিক স্থাপনা উপড়ে ফেলার সাহস ও উদ্দীপনা এসব কবিতা-গানের সংগ্রামী আহ্বানে ধৃত।

নজরুল তাই স্বদেশী চেতনার জাতীয়তাবাদী কবি, সংহত সেকুলার চেতনার কবি-গীতিকার, সর্বোপরি মুক্তিসংগ্রামের চারণকবি। জীবনের সুস্থাবস্থায় নজরুল ইসলাম এ ভূমিকা গভীর নিষ্ঠায় পালন করে গেছেন। এতে ভ্রান্তির কোনো অবকাশ ছিল না। বরং এ নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম রাজনীতিকে সঠিক পথ দেখিয়েছে, যেমন তার কালে, তেমনি কাল পরিক্রমায়।

তিন

নজরুল একদিকে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী কবি, অন্যদিকে পরবর্তী পর্বে মেহনতি মানুষের শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণীশাসন থেকে মুক্তি সংগ্রামের সচেতনতা সৃষ্টিকারী কবি। এককথায় ‘সাম্যবাদী’ কবি, সর্বহারার কবি। তাই লিখেছেন ‘কৃষকের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘জেলেদের গান’ সর্বোপরি নারীমুক্তির গান। এ পর্বে নারীর স্বাধীকার অর্জন; পীড়ন-শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির আহ্বান নানা মাত্রায় প্রকাশিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শৃঙ্ক্ষলিত নারীকে শিকল ভাঙার যে আহ্বান নজরুল জানিয়েছিলেন, সংস্কারের বাঁধ ভাঙার যে ডাক দিয়েছেন তা আজকের বাংলাদেশী সমাজের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশের নারীসমাজ দীর্ঘকাল পর আধুনিকতার পথ ধরে এগিয়ে চলার পরিবর্তে সংস্কারের মধ্যযুগীয় রীতিনীতি ও আচার-আচরণে বন্দী থাকার পথ ধরে চলেছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান নারী সমাজের বড়সড় অংশ। এ বদ্ধাবস্থা থেকে তাদের মুক্তি অপরিহার্য হলেও নারী সমাজের বৃহৎ অংশের পিছু হটা নজরুলীয় আদর্শের বিপরীত ধারার।

একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে নিম্নবর্গীয় মেহনতি মানুষের যে অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি এই সত্য সামনে রেখে নজরুলীয় ভাবনা ও সৃষ্টির ধারায় বলা যায়, যতদিন দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য দূর না হবে, বিশেষত শ্রেণীগতভাবে এবং নারীপুরুষ ভেদে এতদিন নজরুলের সংগ্রামী চেতনা উদ্দীপক কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনা মানুষের মুক্তির জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, লোভের-লাভের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও নজরুল একইভাবে বিবেচ্য। বাংলাদেশের নজরুল চর্চাও এমন এক ধারার অনুসারী হওয়া উচিত।

চার

তবে একথাও ঠিক যে, সংগ্রামের পাশাপাশি নান্দনিক বিনোদনের দিকটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই মানব মনের সাধারণ প্রবণতা গীত গান গজল ভজন এবং অনুরূপ মরমী সহজিয়া ও ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার মতো লোকসঙ্গীতের দিকে। সেক্ষেত্রে বাদ যায় না বাউল বা মারফতি গান। শ্রেণীনির্বিশেষে মানুষ তাই সঙ্গীতভক্ত। গানের অনুষ্ঠানে জমায়েত তাই উপচে পড়ে কী রাজধানীতে, কী শহরে-বন্দরে বা গ্রামেগঞ্জে।

বাঙালির জীবনে বিশেষ কয়েকজনসহ যে দুজন গীতিকার সুরকার-গায়ক সর্বোত্তম ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। তাদের নান্দনিক সৃষ্টিকর্মের শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাদের গানে, এরপর কবিতা এবং অন্যান্য রচনায়। তবে নজরুল সম্ভবত সঙ্গীতের বহুমাত্রিকতায় বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখেন। বিশেষ করে বৈচিত্র্যে, এবং কথা ও সুরে সংগীতের মহামিলনে। যেমন গজল ও প্রেমগীতি তেমনি কীর্তন-ভজন-শ্যামাসঙ্গীত ও ইসলামি গানে। সেই সঙ্গে রয়েছে সংগ্রামী গান, মুক্তির গান।

তাই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির ভুবনে সঙ্গীতের প্রশ্নে দুই অনন্য প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। গানের সংখ্যা বিচারেও নানা ধারার বৈচিত্র্য বিবেচনায় নজরুল বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা দুই হাজারের কিছু উপরে, সেক্ষেত্রে নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। নজরুল গবেষকদের দাবি, নজরুলের বহু গান বিশেষ করে বেতারে ও গ্রামোফোন কোম্পানিতে কর্মরত সময়ের রচনা এখনো আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।

পাঁচ

সবশেষে হলেও সাংবাদিকতার ভুবনে নজরুলের অবদান অসামান্য হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার অধিকারী। ফজলুল হক সাহেবের ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নজরুল সংবাদ পরিবেশনে ও সম্পাদকীয় রচনায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন যা ছিল তার সমকালে সর্বজনগ্রাহ্য। দুই দফায় ঘটেছে এ সম্পাদনা কর্ম। এসবের সংকলন ‘যুগবাণী’ তাঁর প্রমাণ যা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল।

তবে তাঁর নিজস্ব পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং বঙ্গদেশে বিপ্লববাদী তৎপরতার প্রসারে অবিশ্বাস্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। তরুণ ও বয়সী বিপ্লবীরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ও প্রেরণা লাভ করেছেন ‘ধূমকেতু’র বিপ্লববাদী কবিতা, গান ও গদ্য রচনার মাধ্যমে।

আর সাম্যবাদী পর্বে একইভাবে নজরুলের সম্পাদিত ‘লাঙল’ পত্রিকা হয়ে ওঠে মেহনতি ও শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সেতু। লক্ষ্য অর্জনের অবলম্বন। ‘লাঙল’ ছিল মূলত কৃষক-শ্রমিকের মুখপত্র। পরে একই ভূমিকা পালন করে মুজফ্‌ফর আহমদ সম্পাদিত ‘গান-বাণী’ সেখানেও নজরুলের অবদান সর্বাধিক।

প্রকৃতপক্ষে নজরুল-প্রতিভা বহুমাত্রিক। তবে এ প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ গানে ও কবিতায়, এর সর্বোত্তম প্রকাশ মুক্তি সংগ্রামে। সে মুক্তি যেমন উপনিবেশবাদী শাসন থেকে তেমনি শ্রেণীবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য থেকে, সর্বোপরি যা শাসিত-শোষিত নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মাত্র বাইশ বছরের সৃষ্টিশীল ও সংগ্রামী জীবনে (১৯২০-১৯৪২) নজরুল অসাধ্য সাধন করেছেন যা বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
 

 

লেখক: রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়