ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি করেও অসন্তুষ্ট প্রকাশক

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০২, ১৮ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি করেও অসন্তুষ্ট প্রকাশক

ফাইল ফটো

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বই বিক্রি নিয়ে প্রতি বছর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। কিন্তু এ প্রতিবেদন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন প্রকাশকরা।

তারা বলছেন, গৎবাঁধা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে দিলেই হয় না। কিসের ভিত্তিতে, কোন প্রতিষ্ঠান কত বিক্রি করেছে এসবে নিঁখুত তথ্য প্রকাশ করা জরুরি।

তাছাড়া প্রকাশ বা সংশ্লিষ্টদের সাথে বসে যদিও এটি প্রকাশ করে তাহলে সেটি মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু নিজেদের মতো এমন একটি তথ্য বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে যেটি মোটেও মেনে নেওয়া যায় না।

অন্য প্রকাশের সত্ত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘যেখান পশ্চিমবঙ্গে আমাদের চেয়ে বেশি বই বিক্রি হয়, তাদের এবারের প্রতিবেদন বলছে সর্বমোট বই বিক্রি হয়েছে ২৩ কোটি টাকার। অথচ আমাদের এখানে বলা হচ্ছে ৮২ কোটি টাকার বিক্রি। যা একেবারেই ভিত্তিহীন ও আজগুবি একটি রিপোর্ট।

‘আপনি যদি তাদের অতীতের রিপোর্ট দেখেন, তাহলে দেখা যাবে গত সাত বছরে তাদের উত্তরোত্তর বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে হুট করে ৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি বেড়ে গেছে, যেটা একেবারেই অবাস্তব। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রক্রিয়া চলে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় এ বছর ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। আসলে বাংলা একাডেমির ধারণা যে, বই বিক্রি বেশি দেখাতে পারলে বইমেলা সফল হয়েছে বলে প্রমাণ হয়। আসলে বিষয়টা তেমন নয়।”

তিনি আরো বলেন, “যদি ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হতো, তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম আমরা। আসলে এটি বাংলাদেশে এখনো সম্ভব না। তারা আমাদের কাছে মেলা শেষের দিকে একটা তথ্য ফরম দিয়ে থাকে। সেখানে আমরা আমাদের কত বিক্রি হয়েছে সেটি তালিকা দিয়ে থাকি। কিন্তু তাদের উচিত হবে যে তথ্য ফর্মটা পূরণ করা হয়, সেটার আলোকেই তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করা। যেখানে দেখা গেছে এবারের বিক্রি গতবারের চেয়ে কম। অথচ সেখানে মোট বিক্রিতে দেখা গেছে গতবারের চাইতে দুই কোটি টাকা বেশি বিক্রি।

‘তারা কাদেরকে নিয়ে এই তথ্য ফরম পূরণ করেন অথবা এ তালিকা তৈরি করেন জানি না। তারা তো প্রকাশকদের কাউকে জানান না। তাহলে সত্যিকার অর্থেই তারা নিজেরা বসে করেন এবং গৎবাঁধা একটি বক্তব্য দিয়ে দেন। যেখানে আমাদের রাখা হয় না।

‘তারা আমাদেরকে রাখেন না কারণ, প্রকাশকদের রাখলে তারা মনগড়া বক্তব্য দিতে পারবেন না। এটাই মূল বিষয়। আমাদের ধারণা সঠিক ফিগার বললে তারা ৪০ কোটির উপরে কোনোভাবেই যেতে পারেন না।”

আগামী প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী ওসমান গনি বলেন, ‘এটি মনগড়া একটি তথ্য। বাংলা একাডেমি মূলত কিসের ভিত্তিতে এই আজগুবি তথ্য প্রকাশ করে সেটি আমার জানা নেই।’

তিনি বলেন, ‘‘এখন বাংলা একাডেমি বইমেলার পরিসর বাড়িয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যারা পেশাদার প্রকাশক রয়েছে, তাদের অবস্থার দিকে নজর নেই। বলা যেতে পারে তাদের কাছে এখন মানসম্মত বই বিক্রির চেয়ে আয়ের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘মূলত এটি করা উচিত যে, বাংলা একাডেমি বই বিক্রির শেষ পর্যায়ে প্রত্যেকটি প্রকাশনা সংস্থাকে একটি করে তথ্য ফর্ম দিতে হবে। সে ফর্মে একাধিক প্রকাশকের উপস্থিতিতে তাদের বিক্রির তথ্য দেবে। পরে প্রকাশকদের সঙ্গে নিয়ে বাংলা একাডেমির মূল প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। তাহলেই এখানে স্বচ্ছতা প্রকাশ পাবে।

‘যেহেতু এই মেলা একটি জাতীয় উৎসব। সেহেতু যে কেউ বই প্রকাশ করে মেলায় বিক্রির চেষ্টা করেন। সেখানে বইয়ের মানের বিষয়টি চিন্তা করা হচ্ছে না। দেখা গেছে মানহীন অনেক নতুন লেখক নিজেদের বই বিক্রির জন‌্য ক্রেতাদের উৎপাত করতে থাতে। একে অনেকে মানসম্পন্ন বইগুলো কিনতে পারেন না। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির অবহেলা রয়েছে। যে কারণে প্রকাশকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া বিকাশের উৎপাতেও বই বিক্রি ব্যাহত হচ্ছে। বাংলা একাডেমির যদি আসলেই এত টাকার প্রয়োজন হয়, সরকারের কাছে তারা চাহিদাপত্র দিলেই পারে। সরকার কখনো ফেরাবে না, এটি আমি বলতে পারি।”

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক অনন্যা প্রকাশনীর প্রকাশক মনিরুল হক বলেন, ‘এত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে বা এত কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে এ সমস্ত তথ্যগুলো তারা কোথা থেকে পায়? তারা জরিপ কীভাবে করেছে তারাই জানে। যদি বাংলা একাডেমি তাদের নিজস্ব স্টলের বিক্রি মনে করে ১০ কোটি টাকা, সেটির আলোকে যদি তারা বাকি স্টলগুলোকে মূল্যায়ন করে তাহলে তো হবে না।’

যেহেতু আপনারা সমিতির দায়িত্বে আছেন, তাহলে আপনারা বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই তাদের সাথে কথা বলেছেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে তাদের একান্তই প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়। এজন্য আমাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তারা নিজেরাই এটা প্রকাশ করে, নিজেরাই তথ্য নেয়। কিন্তু কোন স্টল কত টাকার বিক্রি করেছে সেটি তারা প্রকাশ করে না। এটি দুঃখজনক। বিষয়টি সঠিক হলে বড়জোর ৩০-৩৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে সারা মাসে।’

অনিন্দ্য প্রকাশের প্রকাশক আফজাল হোসেন বলেন, ‘‘তথ্যটি সঠিক নয়। যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে তাদের প্রকাশ করা উচিত কোন প্রকাশনী কত বিক্রি করেছে। তারা বলছে, বাংলা একাডেমিতে ৮২ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে। এখানেতো শুধু বইমেলার স্টল নয়, সেখানে হোটেলসহ আরো অনেক কিছু ছিল। তাহলে শুধু বই বিক্রি হয়েছে নাকি হোটেলের সকল বিক্রি ধরে তারা এত কোটি টাকা বলছে সেটা আমাদের জানা নেই।

‘তাদের দেখা উচিত আমি কত টাকা ইনভেস্ট করেছি, কত টাকা বিক্রি হয়েছে, আমার কত টাকা লাভ হয়েছে সবকিছু মূল্যায়ন করে প্রকাশকদের সাথে বসে তাদের এই তথ্য প্রকাশ করা।”

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘মূলত প্রকাশনী স্টলগুলো থেকে আমরা যে তথ্য পাই, তার আলোকেই এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে মেলার সদস্য সচিব জালাল আহমেদ সাহেব বিস্তারিত বলতে পারবেন।’

মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘যে প্রকাশনী স্টল বলে যে, মেলার বই বিক্রি কম হয়েছে তাদেরকে নিজেদের সঠিক তথ্যটি দেওয়া উচিত। আমরা প্রত্যেক বছরের হিসাব এবং মেলার ওভারঅল পর্যবেক্ষণ করে নিজস্ব পদ্ধতি অনুযায়ী এ রিপোর্ট প্রকাশ করি। আমরা সবার কাছ থেকে যে তথ্য পেয়ে থাকি সেটার আলোকে আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দুটিকে সামঞ্জস্য করেই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি সব প্রতিষ্ঠানকে মিথ্যা বলব না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সত্য রিপোর্ট দেয়। তবে অনেকেই সঠিক তথ্য দেন না। তখন বাকিদের বিষয়টি হিসাব করে নিজস্ব পদ্ধতির আলোকে আমাদের রিপোর্ট তৈরি করতে হয়। অনেক সময় দেখা গেছে একটি প্রতিষ্ঠানে একদিনেই যেখানে বিক্রি হতে পারে ২৫ লাখ টাকা সেখানে তারা পুরো মাসের রিপোর্ট প্রকাশ করে ৫০ লাখ টাকা। তাহলে সেটি অবশ্যই সঠিক তথ্য নয়। তখন আমরা অন্যান্য প্রকাশনার সাথে কথা বলে এবং আমাদের সাধারণ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ও নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করে রিপোর্ট তৈরি করি।

‘যেখানে একটি বইয়ের পুরো মাসে বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার কপি। তার বিক্রয় মূল্য ২০০ টাকা। মাস শেষে এক বই থেকে তার আয় এক কোটি টাকা। অথচ সে বলছে তার সবমিলিয়ে বিক্রি ৬০ লাখ টাকা।

‘দেখা গেছে, বাংলা একাডেমির একটি প্যাভিলিয়নে এত ভিড় থাকে না। ভিড় না থাকা সত্বেও বাংলা একাডেমি যদি একদিনে পাঁচ লাখ টাকা বিক্রি করে, সেখানে যে প্যাভিলিয়নে সারাদিন ভিড় লেগে থাকে- তার বিক্রি দিনে মিনিমাম ১৫ লাখ টাকা হবে! তাহলে তার সারা মাসে বিক্রি কত?

‘একটি স্টলের দেওয়া তথ্যমতে তাদের বিক্রি হয়েছে এককোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু তার চেয়ে আরো বেশি জনপ্রিয় একটি প্রতিষ্ঠান মাস শেষে তথ্য দিচ্ছে তার বিক্রি ৬০-৮০ লাখ টাকা। তাহলে বিষয়টি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

‘যেখানে দেখা গেছে একটি প্রকাশনী গত বছর দুটি স্টল নিয়েছে, সেখানে এবার নিয়েছে তিনটি। একটি প্যাভিলিয়নে একজন প্রকাশকের ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। এর ভেতর তার ইনভেস্ট আছে। তারপর তার লাভ আছে। তার যদি লাভ না থাকে তাহলে তারা বেশি স্টল নেন কেন? কিন্তু আমি জানি না কেন তারা বিষয়টিকে বিভ্রান্ত করেন। কেন বিক্রির অঙ্কটাকে গোপন করেন। আমি বলতে পারি বাংলা একাডেমি বেশি বলছে না বরং কমই বলছে।”

 

ঢাকা/ইয়ামিন/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়