ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাংলাদেশের আণবিক পাওয়ার প্লান্টের স্বপ্নদ্রষ্টা

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০১, ৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশের আণবিক পাওয়ার প্লান্টের স্বপ্নদ্রষ্টা

রুহুল আমিন : সুধা মিয়া । উত্তরবঙ্গের জেলা রংপুরের পীরগঞ্জের ফতেপুরে জন্ম। চলনে বলনে সাধাসিধে সুধা মিয়া বড় হয়ে হলেন দেশের অন্যতম পরমাণুবিজ্ঞানী। নিজের মেধা দিয়ে নিজস্ব পরিচয়কে বড় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী।

এই পরমাণুবিজ্ঞানীর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৯ সালের ৯ মে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ওয়াজেদ মিয়ার জন্ম ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের  পীরগঞ্জের ফতেপুর গ্রামে।বাবার নাম আব্দুল কাদের মিয়া ও মায়ের নাম ময়েজুন্নেসা। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ।

ওয়াজেদ মিয়া চককরিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ভর্তি হন রংপুর জিলা স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৫৬ সালে ডিসটিনকশনসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি।

পরে ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করেন। পরে ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার অন্য পরিচয় হলো তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬১ সালে ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করার পর ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরিতে যোগ দেন। পরে ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর দেশে ফেরেন। একই বছরের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বিয়ে করেন তিনি। সহজ, সরল, মেধাবী, সদা সত্যভাষী এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় অনন্য এই মানুষটিকে কন্যা শেখ হাসিনার স্বামী হিসেবে পছন্দ করেন বঙ্গবন্ধু। ওয়াজেদ মিয়া-শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশের আণবিক পাওয়ার প্লান্টের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে রয়েছে তার বিশেষ অবদান । তিনি পরমাণু বিজ্ঞানকে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

ওয়াজেদ মিয়া ইতালির ট্রিয়েসটের আন্তর্জাতিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে একাধিকবার গবেষণা করেছেন। গবেষণা করেছেন ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনেও। তার গবেষণা ও জ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে।

১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লীস্থ ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।

এর আগে তিনি ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে পরপর দু'বার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গোটা পরিবারের হাল ধরেন ওয়াজেদ মিয়া। ৮১ সাল পর্যন্ত নির্বাসিত জীবনে ভারতীয় পরমাণু শক্তি কমিশনের বৃত্তির টাকায় সংসার চালিয়েছেন তিনি।

১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পরপর তিনবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দু'বার দু'বছর মেয়াদকালের জন্য ওই  সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার তিনি 'বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি'র সভাপতি নির্বাচিত হন। মাঝে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কারণে কিছুদিন কারাবরণও করেন তিনি। আর সর্বশেষ চাকরি করেছেন পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে। ১৯৯৯ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

ব্যক্তিজীবনে ক্ষমতার ভেতর থেকেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহারের সামান্যতম সুযোগ নেননি তিনি। আপন অবস্থানে থেকেই কাজ করে গেছেন।

ওয়াজেদ মিয়া স্নাতক পর্যায়ের বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থ দুটির নাম  ‘Fundamentals of Thermodynamics’ ও ‘ Fundamentals of Electromagnatic ‘। তার অন্যতম গ্রন্থ  ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। ৪৬৪ পৃষ্ঠার  এই গ্রন্থে বাংলাদেশের বহুল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। তার আরেকটি গ্রন্থের নাম  ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ । বইটি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট এই পরমাণুবিজ্ঞানীর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়