ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাবা আমার মাথার ছাতা

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাবা আমার মাথার ছাতা

একজন বাবা যখন গাজীপুরের একটি প্রবীণ আশ্রমে শুয়ে, আড়ালে বসে, নীরবে বৃক্ষতলায় পায়চারি বা হেঁটে হেঁটে বুকফাটা করুণ বেদনা ঝরান, নিঃসীম অশ্রুজলে চোখ ভিজান প্রিয় সন্তানের জন্য, সেখানে আমার বা আপনাদের তৃতীয় নয়নে জল ঝরানো ছাড়া কিইবা করার আছে? যে সন্তানের জন্য পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন কিংবা ষাট-পঁয়ষট্টি বছর মায়ার জাল ফেলে আদরে-ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছিল, সেই সন্তান এখন যোজন যোজন দূরের মানুষ। সে হয়ত আছে নিজ সন্তান-স্ত্রী নিয়ে অথবা নিজেকে নিয়ে নিজেই আছে সুখ নামক নিজের ভুবনে। বাবা নামক মায়ার পৃথিবী তাকে আর টানে না। বৃক্ষ-শোভিত মধুময় যে গ্রামে বা যে মফস্বলের স্নিগ্ধ ছায়ায় যে সন্তানটিকে জন্ম দিয়ে বড় করতে করতে নিজেই তুলে দিয়েছেন আকাশ পথে, সেই মায়াবি মুখ অশ্রু ফেলতে ফেলতে বিমানের জানালা দিয়ে সাদা মেঘের ভিতর হারিয়ে গিয়ে সাত-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে এক অজানা, অচেনা প্রান্তে। কেউ কেউ ওই প্রান্তের মায়াজালে জড়িয়ে ভুলে গেছে এই নদী মেখলার নরম কাদামাখা মাটি, উড়ন্ত ধুলোবালি, পশু-পাখি, ফুল-ফল আর প্রিয় মুখগুলোকে। কেউ হয়তো বলবেন, এখন তো স্কাইপে, ফেসবুকে, মোবাইলে সহজেই পুরনো বন্ধনকে সুদৃঢ় করা যাচ্ছে। কিন্তু একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন তো জীবন্ত উপস্থিতি আর প্রযুক্তির উপস্থিতি কোনটা বেশি কার্যকর?

আমার নব্বই বছরের বাবাকে ছেড়ে বা রেখে একবারও কোথাও যাইনি। আমিও বাবা হয়েছি। আমার দু’পুত্র যখন ‘বাবা’ বলে ছুটে আসে আমার কাছে, মায়ায় ভরে যায় আমার বুক। ওদেরও সৌভাগ্য যে, আমার বাবা-মা’কে ওরা প্রতিদিন দেখে দেখে বড় হচ্ছে। আমিও প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমার স্নেহময়ী মা (৮৫+) এবং প্রিয়তম বাবার মুখ দেখে দেখে দুঃখ-সুখের জীবন পথে হাঁটছি। বুঝি তাঁরা ছাড়া অন্তর দিয়ে ভালবাসার আর কেউ নেই পৃথিবীতে আমার। বয়স হওয়াতে তাঁরা এখন শিশুর মত আরো মায়াবি হয়ে উঠছেন। অনেক অনেক কথা বলতে চান তাঁরা। যে জীবন-নদী পাড়ি দিয়ে এসেছেন, সেই নদীর দু’পাড়ের অনেক গল্প আছে তাদের। অনেক উপদেশ, অনেক পরামর্শ এখনও আমার প্রতি। তাঁরা দু’জনেই বার্ধক্য ও নানা রোগে আক্রান্ত বলে, আমি কখনো কখনো নীরবে জল ঝরায়। তাঁদের মৃত্যু-ভাবনা আমাকে আক্রান্ত করে, ব্যথিত করে। 

আমার বাবা সব বাবার মতই। আমার বাবা সব বাবা থেকে একটু আলাদা। তিনি সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ যাকে বলা যায়। নিরাহংকারী, সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, আদর্শবান, অত্যন্ত সাহসী, পরোপকারী, সন্তাদের প্রতি আজীবন যত্নবান, ধার্মিক এবং একজন খাঁটি বাঙালি। এখনও নিজের কাপড় নিজে ধৌত করেন। পোশাক-আশাকে সাধারণ। বিলাসিতা করেন না। মিতব্যয়ী। স্বাস্থ্যবান। শ্যামল বাংলার শ্যামল মানুষ।

আমার বাবাকে আমি ‘আব্বা’ বলে ডাকি। নাম মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি শিক্ষক মানুষ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৮৯ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন। বিদায় বেলায় তিনি খুব আবেগায়িত ছিলেন। তাঁর সহ-শিক্ষক ও প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের অশ্রুসিক্ত বিদায়ে তিনিও চোখের টলটলে জল ধরে রাখতে পারেননি। এই সকরুণ মুহূর্তটি সব বিদায়ের ক্ষেত্রেই ঘটে। কারণ মায়া বড়ই কাঁদায়। শিক্ষকতা জীবন শেষ করে সেই বছরই নাড়িপোতা জায়গা ছেড়ে তিনি চলে আসেন নগর ঢাকায়। এই ছেড়ে আসা কতটা সঠিক হয়েছে, কতটা বেঠিক হয়েছে তার অংক বড় জটিল। আমরা সন্তানরা চেয়েছি, তিনি আমাদের সঙ্গে থাকুন আর তাঁর মন হয়ত পড়ে আছে ছায়াভরা গ্রামে। অথচ গ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবন চিন্তা করে তিনি ঢাকায় জায়গা-জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। আমরাও আজ গ্রাম ভুলে গেছি।

আব্বার কথা বলতে গেলে ফুরাবে না। কারণ তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন, তাঁর সঙ্গে প্রতিদিনের মায়া-ভালবাসা, স্মৃতি সহজেই শেষ হবার নয়। তাঁর ঋণও পরিশোধ করতে পারবো না। জন্মদাতার ঋণ কেউ কোনোদিন পরিশোধ করতে পারেনি, পারবেও না। আজকের এই নষ্ট সময়ে কোনো কোনো ভ্রষ্ট কু-সন্তান নিজের পিতাকে খুনও করছে। এটি কী ভাবা যায়? তবু আমরা দেখছি। শুরুতে যেমনটা বলেছি প্রবীণ সংঘে অসহায় বাবার কথা, সেটিও আমরা দেখছি।

বাবার আঙুল ধরে হাঁটেননি, এমন কোনো সন্তান নেই, দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। আমি কতদিন কতবার আব্বার হাতের শক্ত তর্জনি আঙুলটি ধরে কত পথ অতিক্রম করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কতবার তাঁর ঘাড়ে উঠেছি, বায়না ধরে অথবা হাঁটতে হাঁটতে অপারগ হয়ে সেটিরও হিসাব নেই। আমাকে কাঁধে নিয়ে তাঁর অনেক কষ্টে হচ্ছে তারপরও তাঁর কণ্ঠ থেকে গুনগুন গানের সুর বেরুচ্ছে। খেয়াল করতাম আব্বা যখনই হাঁটতেন, তখনই একটি সুর তিনি আওরাতেন। এটি তাঁর নিজস্ব একটি সুর-ধ্বনি। ওই একটিই সুর ছিল তাঁর। তবে মাঝে মাঝে ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি...’ এই গানটি গাইতেন। আসলে ফুল-ফল-পাখি আর নদীর কাছেই কেটেছে তাঁর বহু যুগ। জল-মাটি-কাদার ঘ্রাণ তাঁর চেয়ে কে আর বেশি পেয়েছে? গ্রামের সোঁদা-গন্ধ নিতে নিতে কাটিয়ে দিয়েছেন বেলা। এখন ইট-ক্রংক্রিটের দেয়ালের পাশে শুয়ে থেকে সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে বড় বেশি নাড়াচাড়া করেন। ফিরে ফিরে যেতে চান সেই স্মৃতির নদীঘেষা গ্রামে। কিন্তু শরীর-স্বাস্থ্য তাঁকে সায় দেয় না। জানি, এজন্য নিভৃতে তাঁর বুকে হাহাকার হয়। হৃদয়ে বেদনার জল-তরঙ্গ হয়। ওইটুকু হয়ত আমরা দেখি, হয়ত দেখতে পারি না। আমাদের ব্যস্ততার আড়ালে অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি ধীরে ধীরে জীবন সায়াহ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমিও নীরবে মাঝে মাঝে মন খারাপ করি, বেদনাবোধ করি। কিছুই তো করতে পারলাম না জন্মদাতা পিতার জন্য। একবার ঘুরে আসতে চান তাঁর নাড়িপোতা জন্মভিটায়। হৃদয়ের দাগ যেখানে রেখে এসেছেন। এখন অনেকগুলো রোগ তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে। চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে আসার পর থেকেই নীরব চিন্তায় প্রথমে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হন। টাটকা শাক-সবজি, দুধ-মাছ-মাংস খাওয়া মানুষটি ঢাকায় এসে কৃত্রিম বিষাক্ত-মাখানো খাবার খেয়ে দিন দিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে মুক্ত বাতাসের শ্বাস নেওয়া মানুষটি বন্দি হয়ে গেছেন চার দেয়ালের মাঝে। শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, শ্বাস-কষ্ট, উচ্চরক্ত-চাপ, কিডনির সমস্যা, হার্টের রোগ এসবের কারণে একগাদা ওষুধে ডুবে থাকেন। অপারেশন করা চোখ দু’টো দিয়েই প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা পড়েন, লেখালেখি করেন, কখনো ধীরে ধীরে পায়চারি করেন, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। ফেলে আসা নিজ জেলার ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছেন ‘শেরপুর জেলার ইতিবৃত্ত’। এরপর  লিখছেন তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘জীবনের অনেক বাঁক’। লিখেছেন দুটি ইসলামী গ্রন্থ ‘আমলেই মুক্তি’ ও ‘নবী আউলিয়া ও যিকেরে আকবর’। কুরআন পড়েন। বাকি সময় শুয়ে থাকেন। একবার দেশের বাইরে গিয়েছেন সৌদি আরবে। হজ্ব পালন করতে গিয়ে সেখানে মরুভূমির বালু ও আরব সাগরের জল ও ঢেউ প্রত্যক্ষ করে এসেছেন। স্মৃতিতে নিজের আবাসভূমি ছাড়া ওইটুকুই।    

আব্বা আমার স্বপ্ন পূরণের মূল মানুষ। মা আঙুল উঁচিয়ে চাঁদ দেখাতেন, আব্বা তাঁর বুকে ঘুম পাড়াতেন। যখন থেকে বুঝি, তখন থেকেই আব্বাকে আমি দেখি, আব্বাকে আমি চিনি, আব্বাকে আমি ভালবাসি। আব্বা আমার জীবনের ভূগোল। আমার বেড়ে উঠার বড় আশ্রয়। বড় শক্তি। কত কিছু যে শিখিয়েছেন, তিনি আমার জীবন-শিক্ষক। এখনো বলেন, বাবা, সৎ পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান হলে জীবনে কোনো দিন কোথাও ঠেকবে না। এই কথা আমার জীবনের শুরু থেকেই শুনে আসছি। আমি তাঁর কথায়ই পথ চলছি এবং ভালো আছি। আব্বা আমাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, বাবারা ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। গ্রামে আমাদের সমবয়সী অন্যান্যদের থেকে তিনি একটু আলাদা করে রাখার চেষ্টা করতেন, কারণ তারা অধিকাংশই স্কুলগামী ছিল না। মিশতে দিতো, তবে প্রয়োজনে। বুঝাতে চাইতেন সঙ্গ দোষে আমরা যেন আক্রান্ত না হই। তো আমরা সেভাবেই বেড়ে উঠতে লাগলাম। গ্রামের পাঠ চুকিয়ে শহরমুখী হতে লাগলাম।

আব্বার কথা বলে কী শেষ করতে পারবো? সম্ভব নয়। কত ঘটনা, কত শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে তা কী এই অল্প পরিসরে বলা যায়? শুধু বলি, আমার বেড়ে ওঠা ও আমার জীবন-সিঁড়ির ধাপগুলো পার হতে কী কী করতে হবে, তার তিল তিল ধারণা আমাকে দিতেন এবং এখনো দিচ্ছেন। সেই ছোটবেলায় মাঠে নামতাম খড়ের বল নিয়ে, আব্বা অবাক করে দিয়ে একদিন একটি ফুটবল এনে আমার হাতে তুলে দিলেন (পাকিস্তানের শিয়ালকোটে তৈরি), যেটি আমাদের অত্র অঞ্চলের প্রথম ফুটবল। এই বল দিয়ে গ্রামের সহপাঠীদের নিয়ে সকাল বিকাল শুরু হলো খেলা। আব্বা একদিন কিনে আনলেন বাই-সাইকেল। চালানো শিখালেন।  কয়েকদিন নিয়ে গেলেন নদীতে সাঁতার শিখাতে, পেটে হাত দিয়ে আমাকে ভাসিয়ে শিখালেন সাঁতার। তারপর মনে আছে ভরা বর্ষায় একবার নান্দিনা স্কুল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর মাঝখানে নৌকা ডুবে গেলে, সাঁতার কেটে তীরে ওঠে দুজনকে খুব মনে পড়ল- ১. সৃষ্টিকর্তা ২. আব্বা। আব্বাই আমাকে প্রথম ট্রেনে চড়িয়েছেন। মনে আছে, আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, নান্দিনা থেকে জামালপুর ট্রেনে আব্বার পাশে বসে যেতে যেতে কী যে আনন্দ পেয়েছি, বড় হয়ে মনে হয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’র অপুর মতো ঝিকঝিক আনন্দ। অথচ এর আগে দূর থেকে ট্রেনের ছোটা দেখে মন আনচান করতো, কবে উঠতে পারবো সেই ধাবমান ট্রেনে? আব্বা আমাকে কাঁধে করে আর একটু বড় হলে আঙুল ধরে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন মেলায়, ঘৌড় দৌড়, মইখেলা ইত্যাদি দেখাতে। নিয়ে যেতেনে সন্ধ্যায় গ্রামে যেখানে পুঁথিপাঠ হতো সেখানে, বয়াতি গান শুনাতে, অসুস্থ হলে কবিরাজের কাছে, গ্রামের পাশের হাটে, নিয়ে যেতেন নানার বাড়ি, কখনো কখনো শহরে। শহরে নিয়ে মিষ্টির দোকানে বসিয়ে রসোগোল্লা খেতে দিতেন- আহা বাবার সঙ্গে মধুর দিনগুলো?

আব্বা শিখিয়েছেন সংগ্রহ করা অর্থাৎ ট্রেনের টিকিট, বাসের টিকিট, সিনেমা দেখার টিকিট, বেতার-টেলিভিশনে প্রবেশের পত্র, সব সময়ের পরীক্ষার প্রবেশপত্রসহ সব ধরনের জিনিস। বলতেন পঞ্চাশ-ষাট বছর পর এগুলো স্মৃতি নিদর্শন হয়ে যাবে। তখন আসলে এর মর্ম বুঝিনি, এখন বুঝি। বুঝিনি বলেই, প্রথম রেডিও সেটটি সংগ্রহে রাখিনি, যেটি দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় খবর শুনেছি, চরমপত্র শুনেছি বাড়ির উঠোনে বসে, সেময় আমাদের বাড়িতে আসতো গ্রামের অনেক মানুষ। আব্বা ছিলেন আমাদের অঞ্চলের মাস্টার সাহেব। গ্রামের মানুষের সুখে দুঃখে আব্বা ছিলেন অনন্য মানবিক মানুষ।

আর কত কথা বলবো আব্বাকে নিয়ে! মনে পড়ছে আমার কলেজ জীবনের একটি ঘটনা। আমার ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষার আগে টাইফয়েড হলো। আমি জামালপুর হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে গেলাম। সেই তখন তিনি আমাকে তাঁর হাতের বাহুকে বালিশ বানিয়ে সারারাত ঘুম পারাতেন, সেবা করতেন। তখন আমার আম্মা থাকে ঢাকায়। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন আব্বা আমাকে প্রতিদিন দশ টাকা করে হাত খরচের জন্য আমার বড় ভাইকে বলে দিয়েছিলেন এবং বলেছেন, আমি যেন মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রি নেই। আমি বুঝলাম, তাঁর এই কথা আমাকে রাখতে হবে, কারণ দশ টাকার জন্য যিনি কলেজে ভর্তি হতে পারেননি, সম্ভবত তাঁর সেই কষ্ট আমার মধ্য দিয়ে লাঘব করতে চেয়েছেন। আমি তাঁর কথা রেখেছি।

আব্বা এখনো আমার শরীর, চাকরি, খাবার-দাবার, লেখালেখির খোঁজ খবর নেন। এখনো আমাকে ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাবেন না। আমি যখন তাঁর পাশে বসি, তখন তিনি কথা বলতে বলতে হারিয়ে যান তাঁর জ্বল জ্বল কলা অতীতে, গ্রামের সুখ-দুঃখের দিনে, যেখানে তার স্মৃতিগুলো কেবলই তাঁকে নাড়ায়। কথা বলতে চান, স্মৃতিময় কথা কিন্তু আমরাও সব সময় শুনতে পারি না। দেখি ক্রমশ বয়সে ন্যূয়ে পড়া, ন্যুব্জ জীবনটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে তাঁর চোখের কোনে জমে যায়, দুঃখজল, বলেন, বাবা আমি জীবন সায়াহ্নে চলে এসেছি, পৃথিবীর আলো হয়ত আর বেশি দিন দেখবো না, আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমার ভাল থেকো। আমি বুঝি, মনে মনে হয়ত তিনি বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে- ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর এ ভুবনে...’ বলেন তো, আমার মন তখন কেমন করি? আমার চোখেও জমে জল, বাবাকে হারিয়ে ফেলবো, এমন বেদনায় মন কেঁদে ওঠে।    
একটি ঘটনা বলে এই লেখার আপাতত শেষ করবো। ঘটনাটি আমার পিতা ও জাতির পিতাকে নিয়ে। আব্বা প্রবলভাবে ধারণ করতেন মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। শেখ সাহেব ছিলেন তাঁদের আদর্শের মূল জায়গা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বিভিন্ন সফর শুরু করলেন। তারই অংশ হিশেবে তিনি এলেন জামালপুর। আব্বা মুজিবের এই আগমনে পুলকিত ও তাঁকে এক নজরে দেখার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠলেন। সঙ্গে তার সহকর্মী বন্ধুকে নিয়ে সকাল বেলা রওনা হলেন জামালপুরের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিলেন আমাকেও। আমাদের বাড়ি থেকে জামালপুরের ওই জনসভার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার ছিল। সম্ভবত চৈত্র মাস। প্রচণ্ড রোদ। গ্রামের ছায়াপথ মাড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তপ্ত বালির পথ ধরে আব্বা হাঁটছেন। তাঁর মাথায় ছাতা। আর আমার ছাতা তিনি। আমাদের পাশাপাশি অনেক লোক যাচ্ছে দলে দলে প্রিয় নেতা শেখ সাহেবকে দেখার জন্যে। আমি সারা রাস্তা আব্বার কাঁধে চড়ে যাচ্ছি। আবছা মনে পড়ছে, বেলা ২টার দিকে আব্বা গিয়ে পৌঁছালেন সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধু এসে পৌঁছাবেন হয়ত তিনটা, সাড়ে তিনটায়। কিন্তু আব্বা তাঁর বন্ধুকে নিয়ে জনসভার প্রবেশ পথে আমাকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অনেক প্রহর পাড় করে অবশেষে বিশাল দেহের অধিকারী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার মহান রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন জনসভায়। করতালি ও জয়ধ্বনির মধ্যে প্রবেশ করছেন তিনি। আব্বা সালাম দিয়ে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই হ্যান্ডশেক করলেন এবং কাঁধে বসে আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমার ছোট্ট হাত মুজিবের হাতের স্পর্শ পেল। এই স্মৃতি কী আমি ভুলতে পারবো আজীবন? আমার আব্বার মাধ্যমে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ছুঁয়ে দিতে পেরেছিলাম সেদিন।

আব্বা কী একটি ছোটগল্পের চরিত্র, না উপন্যাসের চরিত্র? একটি উপন্যাসেও তাঁকে ফ্রেমিং করে রাখার মতো নয়, তাঁর জীবন বিশাল বড়, বিশাল বর্ণাঢ্য। আমাকে ছাতা দিয়ে রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে করতে পঞ্চান্ন বছরে জীবন দিয়েছেন, বাবার ঋণ কেউ কী পারে শোধ করতে? আমি কী পারবো? পারবো না, পারবো না, পারবো না... আব্বা আপনাকে খুব ভালবাসি, খুব, খুব...আপনি আছেন আমার সমস্ত জীবনজুড়ে...আপনি আছেন প্রাণের মণিকোঠায়।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়