ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বায়ুদূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ডা. সজল আশফাক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বায়ুদূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকি

নগর জীবনে সুবিধা যেমন আছে, অসুবিধার পরিমাণও কম নয়। নগর মানেই গাড়ি, কারখানা, গ্যাস, পোড়া তেল, ধোঁয়াসহ পরিবেশ দূষণের নানা উপাদান সৃষ্টির উৎস। পরিবেশ দূষণের মধ্যে অন্যতম বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের ক্ষতি খুব দ্রুত ঘটে এবং সরাসরি ধরা পড়ে। কারণ প্রতি মিনিটে কম করে হলেও ১৫ থেকে ২০ বার শ্বাস নেই আমরা। শ্বাসের সঙ্গে দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢুকলে তার প্রভাব খুব সহজেই তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করা যায়। দূষিত বাতাস যে শুধু ফুসফুসকেই আক্রমণ করে তা নয়, নাকে-চোখে- মুখে এবং ত্বকেও এর দূষিত প্রভাব ফেলে।

গাড়ির ও কলকারখানার ধোঁয়া, কয়লাসহ বিভিন্ন ধরণের জ্বালানি থেকে তৈরি হচ্ছে নানান রাসায়নিক পদার্থ। এগুলোর মধ্যে লেড বা সীসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ওজোন, পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইড- এই ছয় ধরণের রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক। সবগুলোই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এইসব রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার এবং ওজোন নিয়ে কিছু ধারণা থাকা ভালো। পার্টিকুলেট ম্যাটার হচ্ছে বাতাসে ভাসমান ২ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার আয়তনের কিছু কণা যার উৎপত্তি মূলত ধুলাবালি, গ্যাস, বিভিন্ন ধরণের ধোঁয়া। এছাড়াও এয়ারকুলার, এরোসল এবং পাওয়ার প্লান্ট থেকেও এগুলোর উৎপত্তি ঘটে। এই রাসায়নিক উপাদানগুলো তরল, গ্যাস এবং শক্ত এই তিনটি রূপে বাতাস দূষিত করে। খুব হালকা হওয়ার কারণে দূষিত এই উপাদানগুলো সহজে ২ থেকে ৭দিনের মতো বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে।

এবার আসা যাক অতিপরিচিত ওজোন সম্পর্কে। ওজোন একধরনের গ্যাস, যার রয়েছে দু'টি ধরণ। একটি থাকে বায়ুমণ্ডলের অনেক উপরে; প্রায় ৩০ মাইল ওপরে। অন্য ওজোন গ্যাস তৈরি হয় ভূমির উচ্চতায়। ভূমির উচ্চতায় যে ওজোন স্তর সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয়- খারাপ ওজোন। এই খারাপ ওজোন আসে মূলত গাড়ি এবং কলকারখানার ধোঁয়া, জ্বালানি তেলের বাষ্প, কিছু ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতিসহ কিছু কেমিকেল থেকে। এই কেমিকেলগুলো সূর্যের আলোর সংস্পর্শে খারাপ ওজোন গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস ভূমি থেকে ৬ মাইল পর্যন্ত উচ্চতায় বিরাজ করতে পারে। এর উপস্থিতিতে আকাশ ধোঁয়াটে হয়ে থাকে। এগুলো শুধু মানব শরীরের জন্যই খারাপ নয়, গাছপালা, শস্যসহ প্রাণীকূলেরও ক্ষতি করে।

এছাড়া ভূমি থেকে প্রায় ৩০ মাইল ওপরে রয়েছে ভালো ওজোন স্তর। এই স্তরের কারণেই পৃথিবীতে ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি আসতে পারে না। ফলে পৃথিবী রক্ষা পায় রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। কিন্তু এই ওজোন স্তরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় অতিব্যবহৃত কিছু গ্যাসের জন্য। এই গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিএফসি। সাধারণত এয়ারকুলিং, এরোসল স্প্রে, ফায়ার এক্সটিংগুইসার ইত্যাদি কাজে এই জাতীয় গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এগুলো ভালো ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বা আল্ট্রাভায়োলেট-রে সহজেই বিনাবাধায় পৃথিবীতে চলে আসতে পারে। ক্ষতিকর এই রশ্মিও ত্বক, চোখের ক্ষতি করে; ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসলের মাঠ, গাছপালা।
 


এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ঢাকার বারিধারায় একিউআই মাত্রা ৩৩৬, আর নিউ ইয়র্কে এই মাত্রা হলো ৩২। একিউআই মাত্রা ০-৫০ হচ্ছে স্বাভাবিক বা ভালো। এই মাত্রা ৩০০ এর বেশি হলে তাকে ক্ষতিকর বলে গণ্য করা হয়। ক্ষতিকর এই পরিবেশের মধ্যে বসবাসরত সবারই রয়েছে নানাধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি। বায়ুদূষণের ফলে মানুষের কী কী ক্ষতি হতে পারে সেই তথ্য দেয়ার আগে কীভাবে বায়ুদূষণ হচ্ছে তা নিয়ে যৎসামান্য তথ্য জানার বিষয়টিকে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করছি। এবার আসা যাক সমূহ স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে।

বায়ুদূষণের ফলে প্রথমত আক্রান্ত হয় ফুসফুস। যার প্রকাশ ঘটে কাশির মাধ্যমে। সবসময় কাশি চলতে থাকে। অবিরাম কাশি। একপর্যায়ে কাশির সাথে যোগ হয় শ্বাস কষ্ট। যা একসময়ে অ্যাজমা বা হাঁপানিতে পর্যবসিত হয়। ফুসফুসের কোষ কার্যকারিতা হারানোর কারণে কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে আরেকটি সমস্যা, যার নাম চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সিওপিডি। সিওপিডি মানে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিজ, অর্থাৎ ফুসফুসে প্রতিবন্ধকতাজনিত সমস্যা। সিওপিডি'তে আক্রান্ত রোগীরা স্থায়ীভাবে কিছু না কিছু শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভোগেন। এই ধরণের রোগীদের অবস্থা একসময়ে এমন হয় যে অক্সিজেন ছাড়া চলতে পারেন না। তারপর পরিণতি যা হবার তাই হয়। দীর্ঘকাল ধরে কেউ যদি বাতাসে বিরাজমান ক্ষতিকর উপাদানসমূহের মধ্যে বসবাস করেন তখন ক্ষতিকর সেইসব উপাদান ফুসফুসের কোষ ভেদ করে গভীরে চলে যেতে পারে। এমন ঘটলে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। ফুসফুসের সঙ্গে হার্ট বা হৃদপিণ্ড সরাসরি সম্পর্কিত, তাই ফুসফুসের কোন দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হলে হার্টের ওপর প্রভাব পড়ে। ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে হার্টের ওপর, হার্ট দুর্বল হয়ে ধীরে ধীরে দেখা দেয় হার্ট ফেইলিওর। এছাড়া শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে পড়া বিষাক্ত কণা এবং গ্যাসের প্রভাব পড়ে নার্ভের ওপর, দেখা দেয় স্নায়বিক সমস্যা, আক্রান্ত হয় নার্ভ এবং ব্রেন। স্নায়ুবৈকল্য, খিটখিটে মেজাজ, স্মৃতি শক্তি হ্রাস, মাথাব্যথাসহ আরো অনেক কিছু। নার্ভের ওপর বিষক্রিয়ার প্রভাব পড়ে ধীরে ধীরে, ক্রমাগতভাবে বাড়ে তীব্রতা। কিন্তু বায়ুদূষণের ফলে চোখ, ত্বক আক্রান্ত হয় সঙ্গে সঙ্গে। চোখজ্বালা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে থাকা, ত্বক চুলকানো, ত্বকে র‌্যাশ ওঠা এগুলো সবই প্রাথমিক এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া। যা থেকে পরবর্তীতে দেখা দিতে পারে চোখে কনজাংটিভাইটিস বা প্রদাহযুক্ত লালচোখ। হতে পারে ত্বকের প্রদাহ, প্রদাহ থেকে ত্বকের আরো জটিল কিছু সমস্যা।

মেডিকেলের ভাষায় বলতে গেলে আরো অনেক সমস্যার নাম হয়তো বলা যাবে, যার অনেকগুলোর অর্থই হয়তো সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য মনে হবে। কিন্তু মূলকথা হচ্ছে বায়ুদূষণ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য নানান চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি তবে বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাসরত নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতিরোধই মূখ্য। এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব বায়ুদূষণ এলাকা এড়িয়ে চলা উচিত, বিশেষ করে ব্যায়াম করার সময়। শীতের সময় এবং যখন রোদ থাকে তখন বায়ুদূষণের পরিমাণ বেশি থাকে। এ বিষয়টিও চিন্তার মধ্যে রাখা উচিত। শ্বাসের সঙ্গে দূষিতবায়ু প্রবেশকে বাধাগ্রস্ত করার কার্যকর উপায় হচ্ছে মাস্ক পরা। বায়ুদূষণ থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ ধরণের মাস্ক রয়েছে। এই মাস্কের নাম এন- ৯৫। এটি বায়ুদূষণ প্রতিরোধে পঁচানব্বই ভাগ কার্যকর। এই মাস্ক ০.২ মাইক্রোন আয়তন পর্যন্ত কণাকে ফিল্টার করতে পারে। আরেকটি মাস্ক হচ্ছে এন- ৯৯, ৯৯% কার্যকর। উভয় ধরণের মাস্কই ৮ ঘণ্টা কার্যকর থাকে। প্রতি ৮ ঘণ্টা অন্তর নতুন মাস্ক ব্যবহার করা উত্তম। সাধারণ মাস্ক এন-৯৫ বা এন-৯৯ এর মতো কার্যকর না হলেও কিছুটা কার্যকর তো বটেই। বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতার বিকল্প নেই, আপাতত ব্যক্তিগত সচেতনতাই হতে পারে একমাত্র অবলম্বন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়