ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় তিন বছর

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৪, ২৮ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় তিন বছর

মামুন খান : প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় দিবালোকে প্রকাশ্যে রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরিকাঘাত করে বখাটে ওবায়দুল। রিশার রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। এই দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে তার সহপাঠীরা। নিয়ে যায় হাসপাতালে। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষণের কারণে রিশাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। নিভে যায় তার মা-বাবার স্বপ্ন। সেই মৃত্যুর তিন বছর হয়ে গেলো। প্রিয় মা-বাবা রিশা হত্যার সঠিক বিচারের আশায় ক্লান্তিহীন ঘুরছেন আদালতের বারান্দায়। তাদের আশা, মেয়ের খুনির ফাঁসি হবে।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বিচারকাজ শিগগিরই শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে ফুট ওভারব্রিজে রক্তাক্ত অবস্থায় রিশাকে পাওয়া যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর ২৮ আগস্ট সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিশার মৃত্যু হয়। রিশা হত্যাকাণ্ডের দিনই তার মা তানিয়া হোসেন রাজধানীর রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালতে বিচারাধীন। মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। একমাত্র আসামি ওবায়দুল হক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আত্মপক্ষ শুনানি করেছেন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ধার্য রয়েছে। 

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, ‘মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আসামির আত্মপক্ষ শুনানি শেষ হয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে রয়েছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে মামলার বিচার শেষ হওয়ার আশা করছি। আসামি যে কাজ করেছে তা অত্যন্ত জঘন্য। প্রকাশ্য দিবালোকে একটা মেয়েকে ছুরি মেরে হত্যা করেছে। তার এমন সাজা হওয়া উচিত যেন ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে সাহস না পায়। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তার সর্বোচ্চ সাজা হবে বলে আশা করছি। 

মামলার বাদী ও রিশার মা তানিয়া হোসেন বলেন, ‘দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেলো আমার মেয়েকে হারিয়েছি। বিচার হবে বলে আশায় বুক বেঁধে আছি। ওবায়দুল আমার মেয়েটাকে বাঁচতে দিল না। ভেবেছিলাম চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আমার মেয়ে বাসায় ফিরবে। পাষণ্ড এমনভাবে আমার মেয়েটাকে ছুরিকাঘাত করেছে যে আর ফিরলো না। আমার মত আর কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয়। যার সন্তান যায় সেই বোঝে সন্তান হারানোর বেদনা। আমার মেয়ের হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিল, ড্রয়িংও করতে পারতো ভালো। এগুলো যে দেখে সেই কেঁদে ফেলে। এখনো ওর রক্তমাখা খাতা রয়েছে আমার কাছে। ওর বাবা সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে। এখনো মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করে।’

তিনি বলেন, ‘মেয়ে হত্যার বিচার পাব- এ আশায় তিন বছর ধরে আমরা আদালতের বারান্দায় ঘুরছি। প্রতি ধার্য তারিখে সকাল ৯টার মধ্যে আদালতে চলে যাই। আর বাসায় আসতে ৫ টা বেজে যায়। শুধু বিচারের আশায় ঘুরছি। আর কিছু চাই না। একটাই দাবি, আমি ওবায়দুলের ফাঁসি চাই। সঠিক বিচার হলে এরকম ঘটনা আর কেউ ঘটাতে সাহস পাবে না। আর ও যদি ছাড়া পায় তাহলে আবারও অঘটন ঘটাতে পারে। আমার দুই বাচ্চার মধ্যে এখনো ভয় কাজ করে। বলে ও যদি বের হয় তাহলে তো আমাদেরও ক্ষতি করবে।’

রিশাকে হারিয়ে এখনো কান্নাকাটি করেন বাবা রমজান হোসেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘আর যেন কেউ এমন নৃশংসভাবে হত্যার শিকার না হয়। যতদিন বেঁচে থাকবো রিশাকে হারানোর শূন্যতা পূর্ণ হবে না। যাকে হারিয়েছি তাকে তো আর ফিরে পাবো না। তবে যে আমার মেয়ে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে, আমি তার সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি। আর আশা করছি মামলার বিচার ভালোভাবে শেষ হবে এবং আমরা ন্যায়বিচার পাবো।’

বাদীপক্ষে আইনি সহায়তাকারী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ফাহমিদা আক্তার রিংকি বলেন, ‘এক বছরের মধ্যেই এ মামলার বিচার কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এ কারণে মামলার বিচার শেষ হয়নি। এখন আর আইনি জটিলতা নেই, শিগগিরই মামলার বিচার পাবো বলে আশা করছি।’

এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মদ বলেন, ‘আসামি নির্দোষ। আসামির বোন ও ভগ্নিপতিকে আটকে রেখে এবং আসামিকে নির্যাতন করে পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। মামলাটির বিচার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করছি। আসামি খালাস পাবে বলে আশা করছি।’

মামলাটি তদন্ত করে ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর ওবায়দুল হককে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার পুলিশ পরিদর্শক আলী হোসেন। এরপর ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল মামলার একমাত্র আসামি ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ওবায়দুল হক বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

অভিযোগপত্রে ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে এ মামলায় আসামি দোষ স্বীকারোক্তি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১ম তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়। এরপর ‘সঠিক আদালতে বিচার না হওয়ায়’ মামলাটি ঢাকার শিশু আদালতে বদলি করা হয়। আইনি জটিলতা শেষে মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসে। এরপর আরও দুইজন সাক্ষীসহ মোট ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। গত ২৫ আগস্ট মামলাটিতে ওবায়দুল হক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আত্মপক্ষ শুনানি করেন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর মামলাটি আত্মপক্ষ শুনানির জন্য ধার্য রয়েছে। আত্মপক্ষ শুনানি শেষে আদালত রায় ঘোষণা করবেন। 

নিহত রিশা রাজধানীর বংশাল থানাধীন সিদ্দিক বাজার এলাকার রমজান হোসেনের মেয়ে। অন্যদিকে ওবায়দুল দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মীরাটঙ্গী গ্রামের মৃত আবদুস সামাদের ছেলে। সে রাজধানীর ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং মলে একটি দর্জি দোকানের কর্মচারী ছিলো। 

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, রিশার মা তানিয়া এই হত্যাকাণ্ডের ৫/৬ মাস আগে রিশাকে নিয়ে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং মলে বৈশাখী টেইলার্সে কাপড় সেলাই করাতে যান। এ সময় রিশার মা ওই দোকানের রসিদের কপিতে ফোন নম্বর দিয়ে আসেন। টেইলার্সের কর্মচারী ওবায়দুল সেই কপি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে রিশাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বিরক্ত করত। 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ আগস্ট ২০১৯/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়