ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিচারের আশায় ছুটছেন আয়েশার মা-বাবা

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিচারের আশায় ছুটছেন আয়েশার মা-বাবা

আয়েশা মনি প্রায় সময়ই হাসি মুখে থাকতো। দরিদ্র মা-বাবা তাদের অভাব-অনটনের সংসারে এই চঞ্চল মেয়ের মুখ দেখেই তৃপ্তি পেতেন।  মেয়ের হাসিতে হাসতেন মা-বাবা।  কিন্তু তাদের সেই হাসি কেড়ে নিয়েছে এক ঘাতক।  মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা মা-বাবা বিচারের আশায় ছুটছেন। 

অভিযোগে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারি গেন্ডারিয়ায় আড়াই বছর বয়সী শিশু আয়েশাকে বাড়ির তিন তলার বারান্দা থেকে ফেলে হত্যা করে প্রতিবেশী নাহিদ হোসেন।  শিশুটির বাবা মো. ইদ্রিস গেন্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন।  মামলাটি তদন্তাধীন।  গেন্ডারিয়া থানা পুলিশের হাত ঘুরে বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।  সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য ছিল।  কিন্তু ওইদিন তদন্ত সংস্থা পিবিআই প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি।  এজন্য আগামী ১৭ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য করেছেন।আদালত।

আয়েশার মা রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘গত জানুয়ারি মাসে আমার মেয়েটাকে হত্যা করা হয়।  আরেক জানুয়ারি প্রায় চলে এলো। এখনো কোন বিচার পেলাম না। সবাই শুধু আশ্বাস দিচ্ছে বিচার হবে।  কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না।  বিচারের আশায় আছি।  তদন্ত কর্মকর্তা আশ্বাস দিয়েছেন বিচার পাবো।  চেষ্টা করছি যেন ন্যায় বিচার পাই।  প্রকৃত আসামির বিচার যেন হয়।’

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার নাওয়া-খাওয়া নাই। আমার বাচ্চার কথা ভুলতে পারি না।  কি কারণে আমার বাচ্চাটাকে খুন করলো।  ১৩ ডিসেম্বর ওর তিন বছর হতো। ওইটুকু বাচ্চা কি ই বা বুঝতো।  কি অপরাধ ছিল ওর। ’

তিনি বলেন, ‘নাহিদ আমার কোলের বাচ্চাকে খুন করছে। তারপরও নাহিদের ছেলে আমাকে বলে, আমি না কি নাটক করতেছি, মিথ্যা বলতেছি।  আমাকে আপোষেরও প্রস্তাব দিয়েছে।  কিন্তু আপোষ নয়, আমি ওর বিচার চাই, ফাঁসি চাই।  ওর বিচার দেখে সবাই যেন ভয় পায়।  আর কেউ যেন কোন মায়ের কোল খালি না করে।  আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করছি।’

আয়েশার বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, ‘নাহিদ আমার দুধের বাচ্চাটাকে হত্যা করেছে।  যার সন্তান যায়, সেই বুঝে সন্তান হারানোর মর্ম।  আমি এর ন্যায্য বিচার চাই। ’

তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মামলাটি প্রথমে গেন্ডারিয়া থানা পুলিশ তদন্ত করে।  পরে পিবিআইকে দিয়ে তদেন্তর আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।  বর্তমানে মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে।  কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি তেমন কিছু দেখছি না।  তদন্ত কর্মকর্তা ঈদের আগে যোগাযোগ করেছিল এরপর আর করেনি।  আমি আশায় আছি, মেয়ে হত্যার বিচার পাবো।  মামলাটির দ্রুত তদন্ত শেষ হবে এবং বিচারে আসামির সর্বোচ্চ সাজা হবে- এ আশা করছি।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র উপ-পুলিশ পরিদর্শক সাদেকুর রহমান বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন, অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে এসেছি।  সর্বাত্মক চেষ্টা করছি মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়ার।  সেই ট্র্যাকেই আছি।  আশায় আছি, ন্যায় বিচারের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে একটা রিপোর্ট দিতে পারবো।’

প্রসঙ্গত, দীননাথ সেন রোডের ৫৩/১/ছ নম্বর চার তলা বাড়ির পাশে টিনশেড বস্তিতে মা-বাবা ও তিন বোনের সঙ্গে থাকত আড়াই বছরের শিশু আয়েশা।  গত ৫ জানুয়ারি বাসায় গ্যাস সংযোগ না থাকায় বিকেলে আয়েশার মা পাশের বাসায় রান্না করতে যান।  তখন আয়েশা রুমেই ছিল।  এক পর্যায়ে আয়েশার মা রুমে আসেন।  তখন মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েন।  সন্ধ্যার পর আশপাশের মানুষের চেঁচামেচি শুনে ছুটে যান বাসার পাশের গলিতে।  সেখানে গিয়ে দেখেন ময়লার ট্রলির পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে তার মেয়ে।  দ্রুত আয়েশাকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিযে যান।  অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

৭ জানুয়ারি শিশুটির বাবা মো. ইদ্রিস বাদী হয়ে গেন্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযুক্ত নাহিদ হোসেন শিশুটিকে ধর্ষণের পর চারতলা বাড়ির তিনতলা থেকে নিচে ফেলে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

মামলা দায়েরের পর নাহিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নাহিদ বাসার তৃতীয় তলার খোলা জানালা দিয়ে লাফ দেয়।  এতে তার দুই পা ভেঙে যায়।  পরে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়।  রিমান্ড চলাকালে নাহিদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় গেন্ডারিয়া থানা পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নাহিদ জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানালে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তদন্ত কর্মকর্তা এরপর আর কোন পদক্ষেপ নেননি।  এজন্য গেন্ডারিয়া থানা পুলিশের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি আয়েশার পরিবার। ৫ মার্চ আইনজীবীর মাধ্যমে গেন্ডারিয়া থানা কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে অপর কোন তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে মামলাটি তদন্ত করার আবেদন করেন আয়েশার বাবা। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।  ২২ ফেব্রুয়ারি চার দিনের রিমান্ড চলাকালে নাহিদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়। পরে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আর কোন পদক্ষেপ নেননি।

আরো বলা হয়, এটি একটি হত্যা মামলা।  যার মেয়ে মারা গেছেন তিনিই বোঝেন।  আইনগত দিকের পাশাপাশি মানবিক দিকটাও বিবেচনা করা দরকার।  এ কারণে অন্য তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করার আবেদন মঞ্জুর করার প্রার্থণা করা হয়।

ওই দিন ঢাকা মহানগর হাকিম ইলিয়াছ মিয়া মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।  পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।  ৮ এপ্রিল নাহিদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পিবিআই।  আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।  রিমান্ড শেষে ২৫ এপ্রিল তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।  এরপর থেকে নাহিদ কারাগারেই রয়েছে।  নাহিদের পক্ষে তার আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর হয়ে যায়।

এদিকে মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ৮ দফা সময় নিয়েছেন দুই তদন্ত কর্মকর্তা।

এদিকে মামলা দায়েরের পরদিন নাহিদের মেয়ে ফাতিহা খান বুশরা আদালতে জবানবন্দি দেন।  জবানবন্দিতে তিনি জানান, ‘ঘটনার দিন (৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে বাবা বাসার বারান্দায় ছিলেন।  এক সময় বাবার রুম থেকে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই।  দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখি তার বাবা বিছানায় আর শিশু আয়েশা তার কোলে কাঁদছে। এ সময় বাবা আমাকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বলেন।  আমি অন্য রুমে চলে যাই।  পরে তিনি (নাহিদ) শিশু আয়েশাকে তিন তলার জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেন।’

 

মামুন খান/ঢাকা/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়