ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বিজয় দিবস যেভাবে কাটান তারা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিজয় দিবস যেভাবে কাটান তারা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : বিজয় দিবস বাঙালির জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। এই বিজয় এমনি এমনি আসেনি। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্র্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে।

 

দেশ স্বাধীনের পর প্রতি বছরই নানান মোড়কে উদযাপন করা হয় বিজয় দিবস। সারা দেশে ছেয়ে যায় লাল সবুজের পতাকা। পরিবর্তন আসে পোশাকে, এমন কি ফেসবুক প্রোফাইল ছবিতেও।

 

যারা জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে বাঙালির মুক্তির সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন সেই মুক্তিযুদ্ধে কেউ হারিয়েছেন জীবন, কেউ শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারিয়ে পুঙ্গত বরন করেছেন সারা জীবনের জন্য। সেই সব  সূর্য  সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে বিজয় দিবস কেমন? রনাঙ্গনের সেই মুক্তিযুদ্ধারা এখন কিভাবে উদযাপন করেন বিজয় দিবস?

 

১৬ ডিসেম্বর এলে সংবাদ কর্মীরা খোঁজখবর নেয়

 

 

টাঙ্গাইল নাগরপুরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মঈনুল হক। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন মেট্রিক পরীক্ষার্থী। ১৭ বছরের টগবগে তরুণ, যুক্ত হন ৫ নং সেক্টরের তামাবিল সাব-সেক্টরের আওতায় গেরিলা মুক্তিযুদ্ধে। তিনি জানান, সিলেট রাধা নগর এলাকায় পাকিস্তানিদের বড় ক্যাম্প ছিল। প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ গজ দূরত্বে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হতো।

 

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ চলছিল, হঠাৎ হানাদারদের মটারসেলের আঘাতে মারাত্বকভাবে আহত হন মঈনুল হক। বাম হাত পুরোপুরি ভেঙে যায়, রণাঙ্গনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে ভারতের শ্রীলং হাসপাতালে নিয়ে যান। দেশ স্বাধীনের পর মঈনুল হককে স্থানান্তর করা হয় সিলেট মেডিকেলে। পরবর্তীতে ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে কয়েক বছর চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।

 

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মঈনুল হকের সঙ্গে কথা হয় মোহাম্মদপুর মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে। জানতে চাই ৪৫ বছর ধরে তার বিজয় দিবসের দিনলিপি। তিনি জানান, বিজয় দিবসের ভোরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান, মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে যোগ দেন নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মিলাদ মাহফিলে, বিকালে বঙ্গ ভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চা চক্রে যোগ দেন। তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর এলে সংবাদ কর্মীরা খোঁজখবর নেয়। ব্যস্ত সময়ে কাটে পুরো দিনই।

 

তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করি

 

 

গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী থানার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াদুদ মোল্লা। ১৯৭১ সালে তিনি কেবল দশম শ্রেণির ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে দেশকে হানাদার মুক্ত করার শপথে ভারতের বিহার প্রদেশের চাকুলিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

 

তিনি জানান, কমান্ডার গামা ভাইয়ের নির্দেশে তার যুদ্ধকালীন অবস্থান ছিল ভাটিয়া পাড়া অঞ্চলে। ১০ জনের ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অপারেশনে যেতেন। নৌকায় পাড়ি দিতে হতো দীর্ঘ পথ। ভাটিয়া পাড়া ওয়ারল্যাস ভবনে পাকিস্তানি ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ১৬ ডিসেম্বর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যখন মুক্ত হতে থাকে, তখনো ভাটিয়া পাড়া হানাদারের কবল থেকে মুক্ত হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ১০-১৫ হাজার এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ভাটিয়া পাড়া পাকিস্তানি ক্যাম্প ঘেরাও করে। পাকিস্তানি আর্মিরা ক্যাম্পে অবরুদ্ধ থাকে। ১৯ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ভাটিয়া পাড়া। ভাটিয়া পাড়ায় বিজয় দিবস আসে ১৯ ডিসেম্বর।

 

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াদুদ মোল্লার সঙ্গে কথা হয় সেগুন বাগিচা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। বিজয় দিবস কিভাবে উদযাপন করেন জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াদুদ মোল্লা বলেন, বিজয় দিবস আমাদের কাছে আনন্দের দিন। মুক্তিযোদ্ধার ক্যাপ পরে ও ব্যাচ লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসে যেই। পরিবারের সবাই একসঙ্গে ভালো-মন্দ খাবার চেষ্টা করি। আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখি। বিকালে এলাকার ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করি।

 

বিজয় দিবস আমার কাছে ঈদের মতো

 

 

যশোর নড়াইল কালিয়া থানার মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মনজুরুল হক। সে সময় ১৯ বছর বয়সী তরুণ মনজুরুল সদ্য আই.এ পাশ করেছেন। রানাঘাট ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রাথমিক ট্রেনিং ও ইন্ডিয়ান আর্মিদের টান্ডুয়া ট্রেনিং সেন্টারে ৫ সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়ে ৮ নম্বর সেক্টরে মুজিব বাহিনীর আওতায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

 

তিনি জানান, কালিয়া থানায় ছিল পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের বড় ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ করতেন হিট অ্যান্ড রান কৌশল অনুসরণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা একটি গুলি ছুড়লে বিপরীতে পাকিস্তানিরা ১০০ গুলি ছুড়তো। ১০ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কালিয়া থানা পাকিস্তানি ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মনজুরুল হক এর গ্রুপে ছিলেন ১১ জন। দুপুর দুইটা পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাগুলি চলছিল। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ১১ জনের প্রত্যেকের হাতে ৫টি করে গ্রেনেড দেন। উনারা ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে ১১ জন এক সঙ্গে আর্মিদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। ক্যাম্পের অধিকাংশ জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২০-২৫ জন আর্মি সৈন্য নিহত হয়।

 

বিকালে পাকিস্তানি আর্মি হাবিলদার ছাদে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পনের সংকেত দেন। অবস্থা বেগতিক দেখে মৌলভী আব্দুল বারেক রাজাকারের নেতৃত্বে ২০০ রাজাকার ক্যাম্প মাঠে অস্ত্র রেখে হাত উচিয়ে আত্মসমার্পন করেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর জয় বাংলা বলে লাফিয়ে উঠেন। পাকিস্তানি হাবিলদার আত্মসমার্পনের নিয়ম ভেঙে আবু বক্করকে নিশানা করে গুলি ছুড়েন। চিকিৎসার জন্য নৌকায় আবু বক্করকে কিছু দূর নেওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আরো কিছু সময় গোলাগুলি চলে। মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেয় আর্মি ক্যাম্প। কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মিকে বন্দি করেন। ১০ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় কালিয়া থানা।

 

মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মনজুরুল হক এর সঙ্গে কথা হয় মোহাম্মদপুর মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে। জানতে চাই বিজয় দিবস কিভাবে কাটান তিনি। মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মনজুরুল হক বলেন, বিজয় দিবস আমার কাছে ঈদের দিনের মতো। সকালে ধানমন্ডি ৩২ এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন করি। বাসায় ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিই। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়