ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিদেশে দুর্গাপূজা || অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিদেশে দুর্গাপূজা || অজয় দাশগুপ্ত

দুর্গা পূজার আমেজ বিদেশে আসলে কেমন? একুশ বছর আগে আমি যখন সিডনি আসি আমার ধারণা ছিল, এখানে পূজা মানে স্মৃতি হাতড়ানো। বড়জোর দেশে ফোন করে ঢাকের বাদ্য শোনা বা সবার সাথে কথা বলা। এমনও হতে পারতো ভিডিও বা অন্য মাধ্যমে পরে ছবি কিংবা চলমান পুজো দেখা। এসে দেখলাম পুজোতো আছেই পূজা নিয়ে ঝগড়াও আছে। কোন কমিটির শক্তি বেশি আর কার দলে কত মানুষ সেটাও বিষয় বৈকি!

সিডনিতে তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ খুব বেশি ছিলো না। এখনো যে খুব কিছু তাও না। তখনও শুনতাম বেশি তেড়িবেরি করলে ওকে বার করে দেব। এতই দাপট! আর এখন বের করা আর ঢোকার বিষয়টা এমন যার পোষায় না সেই আর কিছু বিরক্ত বা বিদ্রোহী হিন্দুদের নিয়ে আরেকটা কমিটি বানিয়ে পূজার আয়োজন করে। নয় নয় করে বাংলাদেশের হিন্দুদের গোটাপাঁচেক পুজো হয় ধুমধামের সাথে। আর এই ধুমধাম কিন্তু এক বা দুদিনের। তিথি মিলিয়ে পূজা করার বিষয়টা সহজ না । কে ছুটি দেবে আপনাকে? কোথায় পাবেন পুরোহিত? আর কে আসবে পুজো দেখতে? তারপরও এখন পাঁচদিন পুজো চালু হয়ে গেছে। মানুষ পারে না এমন কাজ নাই। আর যাঁরা করছেন তারা মূলত ধার্মিক। তাদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
এমন কি আছে বা এমন কি হয় যা দেশে আছে এখানে নাই? পুজোর সামগ্রী থেকে প্রতিমা যেমন আসে তেমনি কার্ডও আসে দেশ থেকে। শুধু কার্ড? পোশাক, গহনা কিংবা সাজসজ্জার সব কিছু এখানে অনলাইনে। আপনি আদেশ করে ক্রেডিট কার্ড নাম্বার জানালেই হলো। সিন্দাবাদের দৈত্য আপনার দরজায় এনে রেখে যাবে সব। বলাবাহুল্য আপনি কিনছেন ডলার পাউন্ড বা বিদেশি মুদ্রায়। আপনার কদর আপনার কোয়ালিটি একটু বেশি হতেই পারে। এ নিয়েও হ্যাপা কম কিছু না। তবে এটা বলি পূজার আয়োজন প্রসাদ কিংবা মনোযোগের বেলা প্রবাসীরা দেশের চেয়ে এগিয়ে। তাদের সময় আর সুযোগ যাই হোক বছরের পর বছর দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে তারা পূজা বা যেকোন আয়োজনে মন প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যখন আমরা এসব অনুষ্ঠানে যাই সে স্কুল, সে মিলনায়তন কিংবা সে জায়গাটি মিনি বাংলাদেশের আকার ধারণ করে। চারদিকে দেশি পোশাকের মানুষজন। বাচ্চাদের আধো বাংলা আধো ইংরেজি উচ্চারণের গান কবিতা কথার ভিড়ে সে আরেক বাংলাদেশি জগত।

আমি কিন্তু ‘বাঙালি জগত’ বলিনি। কারণ দেবী সবার হলেও পূজা যার যার। যার যার মানে ওপার বাংলার পূজা তাদের নিজস্ব। তাদের সাথে আমাদের পূজা মেলে কিন্তু আচার সংস্কৃতি রীতি মেলে না। কোথাও গিয়ে আমরা আমাদের মতো তারা তাদের মতো। আমাদের প্রসাদ বা খাবারের আয়োজন ব্যাপক। তাদেরও আছে। তবে নিয়মমাফিক। আমাদের এখানে লতা থেকে সাবিনা সবার গান চলে। আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক হিন্দী সব গাই, নাচেও তাই। তাদের ভুবনে বাংলাদেশের কোন গান কবিতা কিংবা নাচ কখনো ঢুকতে পারেনি। এমন না যে তারা রুনা লায়লার গান জানেন না। তাদের অনেকেই রুনা বা জেমসের ভক্ত কিন্তু গাইবেন না। গাইতে দেবেনও না। এই যে সংস্কৃতির তফাৎ আমি এটা দারুণ উপভোগ করি। কারণ ঠিক এক কারণে একই বাস্তবতায় লেবানিজ মুসলিম আর বাঙালি মুসলিম একসাথে নামাজ পড়লেও ঈদ করেন আলাদা আলাদাভাবে। এটাই জাতিগত পরিচয়।

দূরদেশে আরেকটি বিষয় আমাকে প্লাবিত করে। মানুষের অদম্য উৎসাহ আর ভালোবাসা। কি যত্ন করে কি মনপ্রাণ ঢেলে যে তারা এসব আয়োজন সাজায় না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। এখন তো আর এমন না যে বাড়িতে বাড়িতে সন্ধ্যায় মেয়েরা হারমোনিয়াম নিয়ে গান শেখে। আর ছেলেরা তবলা বাজায়। এই বাংলাবিহীন দেশ সমাজে থেকেও এরা কষ্ট করে বাংলা গান, নাচ, কবিতা শেখে। রিহার্সেল চলে দিনের পর দিন। এই সুযোগে তৈরি হয় বাচ্চাদের মৈত্রী আর বড়দের ভাঙ্গন। কার সন্তান আগে স্টেজে গেলো কার শিশু বেশি সময় পেলো এসব নিয়ে মনোমালিন্যের মধুরতা আছে। তবে সবচেয়ে মজা পাই ক্যামেরার বহর আর আলোর ঝলক দেখে। যার বাচ্চাই স্টেজে উঠুক ফ্ল্যাশ আর ক্যামেরার ঝলকানি দেখলে দেশের বিখ্যাত শিল্পীরাও মুর্চ্ছা যাবেন বৈকি! আমার এখনো মনে আছে অর্ক এদেশে এসেছিল আট বছর বয়সে আর পূজার অনুষ্ঠানে আবৃত্তি নাটক এসব করতো প্রায় চৌদ্দ বছর বয়স অবদি। এই ছয় সাত বছরে আমার গিন্নীর বড় অভিযোগ ছিলো আমি কখনো অন্যদের মত ছবি তুলিনি তার। ভিডিও করিনি বলে। যতটা পারতো ওর মাই করতো। আমি কেন যেতাম না সেটা এখন বলা যায়। আমর সংকোচ ছিল সাদামাটা সনি ক্যামেরা আর চলনসই ভিডিও ক্যামেরার কারণে। চারদিকে আলো ঝলমল ক্যামেরা আর বাহারি সব ভিডিওর কাছে সাধারণ যন্ত্রকে ছোট হতে দেইনি আমি। এও দেখার মত পর্ব। এই উৎসাহ দেশে দেখবেন না। আর দেশে অতিথি কেউ না এলে বাকীরা অনুষ্ঠান করলেই কি, না করলেই বা কি। যদি অদিতি মহসীন আসেন তবেই নামবে লাখো মানুষের ঢল।

বিদেশে মানে প্রবাসে পূজার আরেকটা মজার দিক মিলনমেলা। অনেকদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি, নাম ভুলে যাওয়া মানুষ আপনাকে চমকে দেবেন। আপনি মনে মনে খুঁজছেন অথচ দেখতে পাননি এমন কোন মুখশ্রী আপনাকে দেখে বলেব- দাদা নমস্কার। এই চাওয়া পাওয়া মূল্য দিয়ে কেনা যায়? যারা পুরোহিত তাঁরা দেশের চেয়েও কড়া। পাঁচদিনের পুজো দুদিনে হয় বলে তাঁদের কষ্ট বেশি। তবু তাঁরা অক্লান্ত। এখন যোগ হয়েছে স্মৃতিমেদুর মহালয়া। সব মিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশে দেবী আসুক না আসুক পূজা আসে বিদেশে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়