ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘বিমান হামলাতেও সেদিন ক্ষতি হয়নি’

মামুনুর রশিদ রাজিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বিমান হামলাতেও সেদিন ক্ষতি হয়নি’

আবদুল আজিজ সরকার

মামুনুর রশিদ রাজিব : বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষদের নিজের অধিকারগুলো বুঝে পেতে বারবার সংগ্রাম করতে হয়েছে, হাতে তুলে নিতে হয়েছে অস্ত্র। বিনিময়ে দিতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত। কখনো আঘাত হানা হয়েছে ভাষার ওপর, কখনো স্বাধীনতা তথা বাঙালির অস্তিত্বের ওপর। কিন্তু, বাঙালি হার মানেনি।

সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভের পরও যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করল না, তখন বাঙালি বুঝে গিয়েছিল, এই পবিত্র ভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে তাদের আরো একবার রক্ত দিতে হবে। তাইতো শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে...।’ আর সে ডাকে সাড়া দিয়েই মুক্তির নেশায় রাজপথে নেমে এসেছিল এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা। তাদেরই একজন তৎকালীন ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ সরকার। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি দীর্ঘদিন চৌবাড়ী ড. সালাম জাহানারা কলেজে অধ্যাপনা শেষে ওকালতি পেশায় কর্মরত আছেন সিরাজগঞ্জ জজকোর্টে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আজিজ সরকার ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরেই যমুনা নদীর বিভিন্ন চরে অস্ত্র চালানোর প্রাথমিক ধারণা নিতে থাকেন। এক সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেন। কখনো রাজাকারসহ পাকবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলতেন গেরিলা আক্রমণ করে, কখনো নদী কিংবা রাতের আঁধারে সম্মুখ যুদ্ধ করতেন বীরদর্পে। কখনো হয়তো অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পিছু হটতে হয়েছে তাকে কিন্তু মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন কামারখন্দ, বেলকুচি, তারাশ, রায়গঞ্জ এবং সিরাজগঞ্জ সদর থানাসহ সিরাজগঞ্জ জেলার আনাচে-কানাচে। একসময় তারা ৪০০-৪৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গড়ে তোলেন পলাশডাঙ্গা যুব শিবির। এই শিবিরের মাধ্যমে যুদ্ধটাকে আরো সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা হয়।

এক সময় তারা যুদ্ধের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে নিরাপদ জায়গা হিসেবে নওগার হান্ডিয়া হাটকে বেছে নেন। তাদের এই গোপন আস্তানার কথা পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছালে তারা হাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে এই খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছালে তারাও প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১১ নভেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘন কুয়াশার মধ্যেই তারা একটু দূরে একদল পাকিস্তানি সৈন্যের অবস্থান অনুমান করেন এবং পর্যায়ক্রমে দলটি তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকায় একসময় তারা নিশ্চিত হন পাকিস্তানি সৈন্যদের বিষয়ে। একপর্যায়ে, পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন অনেক কাছাকাছি চলে আসে, মুক্তিযোদ্ধারা তখন গোলাগুলি শুরু করলে পাকিস্তানি সৈন্যরাও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পজিশন নিয়ে বিপরীত দিক থেকে গোলাগুলি শুরু করে। তুমুল যুদ্ধ চলে হান্ডিয়ার হাট এলাকায়। কিন্তু  মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। তখন সাধারণ জনগণের সহায়তায় পাঁচ-সাতজন সৈন্যকে আটক করে মেরে ফেলা হয়।

সৈন্য নিহতের খবর পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে পৌঁছালে পরদিন হান্ডিয়া হাট এলাকায় তুমুল বিমান হামলা শুরু হয়। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ১১ নভেম্বর এবং পরদিন বিমান হামলায় মুক্তিযোদ্ধাসহ কোনো বাঙালির প্রাণহানী ঘটেনি। দেশ এখন স্বাধীন। যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তা কতটুকু পূরণ হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ সরকার বলেন, আমরা সেদিন বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। যুদ্ধ করেছিলাম দেশকে তথা দেশের মানুষকে শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করতে। সেদিন ঠিকই পাকবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্তও যখন দেখি কিছু স্বার্থান্বেষী মহল মুক্তিযুদ্ধ না করেও, এই সমাজটাকে তাদের হাতের পুতুল করে সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থ হাসিল করেন, তখন কষ্ট লাগে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়