ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিশ্বকাপে বিশ্ব কাঁপে

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ২৬ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বকাপে বিশ্ব কাঁপে

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : একটা সময় ছিল বিশ্বের খুব বেশি দেশ ক্রিকেট খেলত না। এখনো যে সবাই খেলে, তাও নয়। তবে অনেক দেশ আছে, যারা সম্প্রতি খেলা শুরু করেছে। ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির এখন সহযোগী সদস্য দেশের সংখ্যা ৯২টি। পূর্ণাঙ্গ সদস্য দেশ ১২টি। এরা ‘টেস্ট ক্রিকেট’ খেলার অনুমতি পেয়েছে। সব মিলিয়ে শতাধিক দেশ এখন ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে। তবে ১২/১৪টি দেশ ছাড়া বাকি দেশে ক্রিকেট সীমিত পরিসরে মুষ্ঠিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ পৃথিবীর সব দেশে কম-বেশি ফুটবল খেলা প্রচলন আছে। সারা বিশ্বে ফুটবল ব্যাপক জনপ্রিয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশকে এক কাতারে বেঁধে রেখেছে ফুটবল।

জনসংখ্যার বিচারে, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ অর্থাৎ উপমহাদেশের প্রায় ১৫০ কোটি জনসংখ্যার বড় অংশ ক্রিকেট খেলার দর্শক। এই তিন দেশে ক্রিকেট ভীষণ জনপ্রিয়। অর্থাৎ ক্রিকেট বাণিজ্যের অধিকাংশই এই উপমহাদেশ ঘিরে। তবে সম্প্রতি আরেক শতাধিক কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনও ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের একজন কৃতী   ক্রিকেটার আমিনুল ইসলাম বুলবুল আইসিসির তত্ত্বাবধানে চীনে কয়েক বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। চীন যদি কখনো ক্রিকেটে পরাশক্তি হয়, সেখানে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে এক বাংলাদেশির নাম।

উপমহাদেশে ফুটবল খেলা জনপ্রিয় হলেও বিশ্ব টুর্নামেন্টে তেমন অর্জন নেই। তাদের কখনো ফুটবল বিশ্বকাপে খেলা হয়নি। যত অর্জন সব ক্রিকেট ঘিরে। ভারত, পাকিস্তান এবং পাশের দেশ শ্রীলংকা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আরেক পরাশক্তি হওয়ার পথে বাংলাদেশ। যে খেলার মাধ্যমে জনগণ নিজেদের বিশ্ব আসরে দেখতে পারে, সেখানে মানুষের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবে বেশি। এবারের বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১০টি দেশের মধ্যে অর্ধেকই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ।

একটা সময় ছিল, যখন খেলা ছিল নির্মল বিনোদনের উপকরণ। এখন সময় বদলেছে, বিনোদনের মধ্যে প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে বাণিজ্য। এখন খেলা মানে কাড়ি কাড়ি অর্থ। বহুজাতিক আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বিশ্বকাপের মতো আসর ঘিরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে মুখিয়ে থাকে। অবশ্যই এটা লাভজনক বিনিয়োগ। বিনোদন পরিবেশনের সঙ্গে পণ্যের প্রসারই তাদের উদ্দেশ্য।

তবে এত অর্থ, এত জৌলুশ, এত চাকচিক্য আর উন্মাদনার মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে খেলায় কী সহজাত বিনোদন হারিয়ে যাচ্ছে? এত আড়ম্বর আয়োজন, চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যের মধ্যে খেলা কী তৃপ্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে? খেলা উৎপাদনশীল পণ্য নয়, এটি টিকিয়ে রাখতে পৃষ্ঠপোষক দরকার। কম-বেশি বিনিয়োগও আসতে পারে। কিন্তু অতি বাণিজ্যিকরণে খেলা তার সহজাত চেহারা হারিয়ে ফেলে। এটি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

সময়ের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। শারীরিক শক্তি-সামর্থ, মানসিক শক্তি এবং দক্ষতা-কৌশলের খেলা আজ ঝুঁকে পড়েছে পেশীশক্তির ওপর। এখন যত বেশি রান, তত বেশি উন্মাদনা। যত বেশি চার, ছয়, তত বেশি হৈ হৈ। এতে খেলা স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে। ক্রিকেটের আসল পরীক্ষার খেলা ‘টেস্ট খেলা’ এখন আর কেউ খেলতে চায় না। বেশি ঝোঁক এখন নতুন আবিষ্কৃত ফরম্যাট টি-২০’র দিকে। যেটা শুধু ‘পাওয়ার’ প্রদর্শনের জায়গা।

ক্রিকেট খেলার এই পরিবর্তনের পেছনে ‘সময়ের স্বল্পতা’ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এখন খুব ব্যস্ত। উদায়-অস্ত তাকে ছুটতে হয়। তার হাতে ফুসরৎ নেই। সেখানে পাঁচ দিনের ক্রিকেট খেলার খবর রাখার মতো অবস্থা তার থাকে না। ওয়ান ডে ম্যাচের ওপর নজর রাখতে হলে ৬/৭ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। দিনের বড় অংশ চলে যায় খেলা দেখতে। এতটা সময় এখন মানুষের হাতে থাকে না। টি-২০ ফরম্যাট জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ এর ছোট পরিসর। কে জানে একদিন হয়ত এটিই ক্রিকেটের মূল ফরম্যাট হয়ে যাবে।

আগেই বলেছি, মানুষ নিজেকে সেখানেই দেখতে চায়, যেখানে সে জয়ী। বাংলাদেশে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার কারণ এটিই। দুই দশক আগেও ক্রিকেট এ দেশে এতটা জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ দল আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেল। এরপর থেকে দ্রুত জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এখান গ্রাম-গঞ্জের মাঠে-ঘাটে শিশুরা ক্রিকেট খেলে। আর সাকিব-তামিমরা খেলে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপে। আজকের শিশুদের সামনে সাকিব-মুশফিক-মুস্তাফিজরা আইডল। এই শিশুরা একদিন এদের ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

বিশ্ব ক্রিকেটে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত নবীন দেশের একজন বিশ্ব তারকা সাকিব আল হাসানকে যখন রানে-উইকেটে সবাইকে ছাড়িযে যেতে দেখি, তখন গর্ব অনুভব করি। বাংলাদেশের মানুষের এমন গর্ব অনুভর করার মতো খুব বেশি অর্জন নেই এবং বেশি সুযোগও আসে না। এ কারণে হয়ত ক্রিকেট এত জনপ্রিয়। ক্রিকেট ঘিরে এ দেশের তরুণদের মধ্যে এত উন্মাদনা। ইংল্যান্ডে বিশ্ব কাঁপিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের ১৫ জন তরুণ। কাঁপাচ্ছে সাকিব আল হাসান। আর হয়ত বেশি দূরে নয়, এদেশের তরুণরা বিশ্বকাপ ট্রাফি নিয়ে দেশে ফিরবে।

খেলা নিছক বিনোদন। কিন্তু এই বিনোদনের মুহূর্তটা আমাদের একসঙ্গে বেঁধে রাখে।। ভিন্ন ভিন্ন দলের-মতের, ধর্মের-বর্ণের সবাই একসঙ্গে টিভির সামনে বসে যায়। সবার একটাই চাওয়া থাকে- দেশের জয়। দল যখন জেতে, সবাই একসঙ্গে চিৎকার দেয়, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। এমন ঐক্য অন্য বিষয়ে দেখা যায় না।

আমাদের জীবনে অপ্রাপ্তি সীমাহীন। অভাব-অনাটনের সংসারে দুঃখ-যন্ত্রণায় পিষ্ট। একটু ভালো থাকতে উদয়-অস্ত ছুটে চলি। বিরামহীন সেই চলা। এর মধ্যে কিছুটা সময় করে টিভি খুলে বসি, দল হারলে আফসোস করি, জিতলে হৈ-হুল্লোড় করি। ক্ষণিকের জন্য হলেও দুঃখ-বেদনা দূরে ঠেলে রাখতে পারি। ক্রিকেট সেই সুযোগটুকু করে দেয়।

লেখক : সাংবাদিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৯/বকুল/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়