ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিস্মৃতের জার্নাল: বাংলা সাহিত্যে নবতর শিল্পরীতির উদ্ভাস

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ২০ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিস্মৃতের জার্নাল: বাংলা সাহিত্যে নবতর শিল্পরীতির উদ্ভাস

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী: আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতায় বরাবরই দেখেছি কোনো এক বিশেষ রীতির শিল্পআঙ্গিকে আমরা পরিভ্রমণ করেছি। যখন গদ্যের সঙ্গে বসবাস করেছি তখন পদ্যকে করেছি শত্রু। কেননা আঙ্গিকের ক্ষেত্রে সকল সময়েই আমরা একমুখী পথ চলতে চেয়েছি। আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতাও এমন। অথচ বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সে ক্ষমতা ছিল। তিনি চাইলে গদ্য আর পদ্যের মিশ্রণে আমাদের সাহিত্যে নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার করতে পারতেন। এমন অসংখ্য নাম বাংলা সাহিত্যে আছে যারা গদ্যরীতির সঙ্গে পদ্যরীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে পাঠকের ভাবনা নিয়ে কাজ করতে পারতেন। সে আমাদের নমস্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের সৈয়দ হক কিংবা মান্নান সৈয়দ যে কেউ। যা ঘটেনি তা নিয়ে দুঃখ করে কী লাভ? বরং যা ঘটেছে তা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে-

আমরা যখন কোনো একটি কবিতা পাঠ করি তখন একটি চিত্রকল্প আমাদের মনে অঙ্কিত হয়ে মুছে যায়। আবার নতুন এক চিত্রকল্প তৈরি হয়। চিত্রকল্পের নিয়মই তাই। নানা চিত্র নিয়ে আমরা বসবাস করি কবিতায়। কখনো কখনো মনে হয়, কোনো একটি বিশেষ চিত্র যদি আমার সঙ্গী হয় তো মন্দ হয় না। গদ্য-পদ্য-আলোকচিত্র এই তিনের সমবায়ে নির্মিত হয়েছে গ্রন্থ ‘বিস্মৃতের জার্নাল’। রচয়িতা দুজন, একজন অক্ষরের সাহায্য নিয়েছেন, অপরজন আলোছায়া। সব মিলিয়ে এক নতুন ব্যঞ্জনা পেয়েছে বাংলা প্রকাশনা এবং সৃষ্টিশীলতার জগতে। এর প্রারম্ভিকা রচনা করতে গিয়ে মুম রহমান চিহ্নায়ন করেছেন ‘দৃশ্যগ্রাহ্য ভোজ’ হিসেবে। আমরা যখন কোনো একটি লেখা পাঠ করি তখন আমরা তার চিত্রকল্পের সঙ্গে চলতে থাকি। আবার উল্টোপথে যখন একটি আলোকচিত্র দেখি, তখন কতো না কথা ভেসে যায় মনের অন্দরে। কিন্তু দুটো এক জায়গায় রাখলে কী ঘটতে পারে। একে রাজনীতির তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়-বিস্মৃত জার্নালে রচিত কোনো একটি গদ্য বা পদ্য পাঠ করতে করতে থিসিস রচিত হয়ে যায়। আবার যখন আলোকচিত্রটি দেখি তখন মনে হয় এই রচনার ছবি তো এটা নয়, আবার এটা হতেও পারে। এমনি ভাবনার মধ্য দিয়ে এন্টিথিসিস তৈরি হয়। আর এই দুইয়ের বিক্রিয়ায় সিনথিসিস তৈরি করতে চান রচয়িতাদ্বয়।

প্রথমে বর্ণমালার শক্তি দেখতে নামি- তিনি মানুষকে উপলক্ষ্য করে পাঠককে দার্শনিকতায় জারিত হতে দিতে চান। তাইতো লিখেন:

‘জীবনের আর কোনও বোধ

নয়তো তোমার মুখশ্রীর চেয়ে দামি।’

পাঠক হিসেবে আমরাও চলতে থাকি সে পথে যেখানে বোধ তৈরির ভিত্তি হয় বস্তু। বস্তুবাদী এক লেখক চলতে চান কল্পলোকের পথে। আমরা পাঠ করতে থাকি আল্লাদিত্তা মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের রচনা। সমুদ্রতীরে বসে ভালোবাসার সঙ্গে দর্শন, স্মৃতিচারণ, প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির নানামাত্রিক চিন্তনে সাঁতার দিতে থাকি। আমাদের চারপাশের বাতাস, সে শুধু অক্সিজেন সরবরাহ করেই বাঁচিয়ে রাখে না। একই সঙ্গে এক লেখকের উড়বার শিক্ষক হয়, কিন্তু বাতাস পাখিদের উড়তে শিখিয়ে আল্লাদিত্তাকে বেদনার জলে ভাসায়। তিনি বলেন, ‘আমি আর কোনো দিনই/ উড়তে শিখব না।’

আহা! এই কষ্টে শিল্পী বলতেই পারেন- ‘আপনি এসে চলে গেলেন বাতাসের মতো আর এখন আমি নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস।’ আমরা আলোকচিত্র আর লেখার সঙ্গে চলতে চলতে নতুন নতুন চিন্তনের স্রোতে ডুব দেই আর ভেসে উঠি আপন ভাবনাকে দেখার লোভে। আল্লাদিত্তা মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের কাছে অর্জুন মহাভারতের বীর নয়, সুষমিত, তেজদীপ্ত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ পুরুষ। আর সেখানে ধর্মের যোগ।মানুষ বেঁচে থাকতে চায় পৃথিবীর সমান। কিন্তু তার সে স্বপ্ন দেয়ালে আঘাত খেয়ে থমকে যায়। ঘাস ফড়িংয়ের জীবন নিয়ে মানুষের যে হতাশা সেই হতাশায় ডুবে যান তিনি। কবিতা, নারীর আশ্লেষ, নির্জনতা, পেয়ালা- নানা টকুরায় তিনি এক মানুষের মুখ আঁকতে চান। আমরা তার সঙ্গে সাধনায় ডুবে যাই। যিনি শিক্ষার জগতে প্রযুক্তির সঙ্গে আত্মীয়তা করলেও শিল্পের ভুবনে সাধক।

এবার আরেক নির্মাণশিল্পী আবিদ এ আজাদের কথা কিছু লেখা যেতে পারে। তিনি যে আলোকচিত্র এই গ্রন্থের জন্য নির্বাচন করেছেন তা দেখে বলাই যায়-আলো আর ছায়াকে খেলনা বানিয়ে নানা কিছু গড়েন আবার ভাঙেন। তাঁর আলোকচিত্র কখনো কখনো চিত্রকর্ম হয়ে ওঠে। পাতার গায়ে জলের নাচন অথবা তার তোলা ঘড়ির ছবির দিকে তাকালেই যে কারো ভেতরে চিত্রকর্ম দেখার বিমোক্ষণ ঘটবে। অথবা সাগরের লোনা জলে পা ডুবিয়ে যে নারী জাল কাঁধে তুলে নেয় তার কথা ভাবতে ভাবতে দেখার মাঝে আরেক দেখা জন্ম নেয়। তার চটির ছবি দেখে যে কেউ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংযোগ পাবেন।

বাংলার সৃষ্টিশীলতার জমিনে তারা দুজন বুনেছেন নতুন বীজ। একদিন আমরা সেখানে স্বর্ণালী ফলন দেখতে পাবো। যে শিল্পরীতির উদ্ভাস তারা ঘটান তাতে আমরা আপ্লুত হই। প্রকাশনায় ভাবনার ছাপ রয়েছে সে গ্রন্থের ডিজাইন, কাগজের ব্যবহার আর মুদ্রণ সৌকর্যের ক্ষেত্রে বলা যায় কোনো সন্দেহ ছাড়াই।‘ক্রিয়েটিভ ঢাকা লিমিটেড’ নামের এই প্রকাশনা সংস্থাটি এজন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে। মূল্য প্রসঙ্গে তারা ভূমিকায় ব্যাখ্যা দেওয়ায় আর কিছু লেখা হলো না। তবে নির্মাতাত্রয়-গদ্য-পদ্য রচয়িতা, আলোকচিত্রী এবং প্রকল্প পরিচালকের কাছে আশা থাকবে তারা তাদের নির্মাণকর্ম অব্যাহত রাখবেন তবেই আমরা ‘ক্রিয়েটিভ ঢাকা লিমিটেডে’র কাছে  নতুন ধরনের বই পাবো।

বিস্মৃতের জার্নাল

আল্লাদিত্তা মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের গদ্যপদ্য

আবিদ. এ. আজাদ আলোকচিত্রায়িত

প্রকাশক: ক্রিয়েটিভ ঢাকা লিমিটেড

মূল্য: ৯৫০.০০ টাকা

প্রকাশকাল: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়