ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বেলাশেষের আনন্দগান

পিয়াস মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেলাশেষের আনন্দগান

আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, অধিবর্ষের বইমেলায় আজ বেজে উঠবে বিদায়-রাগিণী। ভাঙবে প্রাণের মেলা, মিলনবেলা। জীবন মানে যদি হয় আনন্দ-বেদনার কাব্য, বইও তবে আনন্দ-বেদনার খনি। আর বইকে ঘিরে যে মেলা; তার শুরু-শেষ মিলে আনন্দ-বেদনার মিলিত রেশ তো থাকবেই। তবে বইমেলা থেকে সংগৃহীত প্রতিটি বই-ই যেহেতু আমাদের সম্ভাব্য পাঠ-আনন্দের অপার উৎস সেহেতু বইমেলার সমাপ্তি নেই কোনো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এর সমাপ্তি ঘটবে, তবে আমাদের পাঠকের মনের ময়দানে বইমেলার কোনো সমাপ্তি হবে না। চলছে, চলবে।

এবারের এক মাসের অক্ষর-উৎসব ছিল অন্য যেকোনোবারের চেয়ে বিপুল বর্ণিল-বিচিত্রি-বর্ণাঢ্য। ২০২০-এর বইমেলা পরিসরগত বিস্তৃতি ও নান্দনিক বৈভবের দিক দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গিত এই মেলা ছিল এখন পর্যন্ত তাঁর স্মরণে সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন। মেলার মাঠের সঙ্গে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও সন্নিহিত জলাধারের কোনো সীমানাপ্রাচীর না তোলায় তা হয়ে উঠেছিল প্রাকৃতিক শোভাসৌন্দর্যের এক নিরূপম নজির। শিশুদের জন্য আমরা ‘হ্যাঁ’ বলতে প্রত্যয়বদ্ধ তাই শিশুকিশোরদের জন্য শিশুকর্নার, সপ্তাহে দু’দিন শিশুপ্রহর, শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতা, হাতেখড়ি নামে নতুন কর্মসূচি সাড়া জাগিয়েছে বেশ। আর স্বস্তি দিয়েছে ধুলোমুক্ত পরিবেশে পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা।


 

লেখক বলছি, কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা, নাটক ও যাত্রাপালা এবং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে পঁচিশ দিন পঁচিশটি সেমিনার বইমেলাকে বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চাঞ্চল্যের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, বাংলা একাডেমি মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পরিকল্পিত ১০০টি বইয়ের ২৬টি এই মেলাতেই প্রকাশ করেছে; যার প্রথম বইটি ছিল বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’। মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচনকৃত এই বই প্রথম বিশ হাজার কপি বিক্রির রেকর্ড সৃষ্টি করেছে মেলার প্রারম্ভভাগেই। এবার বইমেলা দেখতে-ঘুরতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক মানুষ ছাড়াও বিদেশে বসবাসরত বাঙালি এবং বাংলাদেশে কর্মরত কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা সাগ্রহে এসেছেন। সস্ত্রীক মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ভারতীয় হাইকমিশনার এবং কম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী-সহ অনেকেই প্রাণের টানে এসেছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, দেখেছেন মননের মধু কত বিচিত্র বিভায় সঞ্চারিত বাংলাদেশের মানুষের মনে!

ছোট্ট ডানায় অসীম আকাশ ধারণ করা লিটলম্যাগাজিন চত্বর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরও এবারের মেলায় একটি বড় ঘটনা। বইমেলা শুধু জ্ঞানের উৎসব নয়, একই সঙ্গে তা আমাদের জাতিগত শৃঙ্খলা, সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার চলন্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এবারে যে সুশৃঙ্খল-শান্তিপূর্ণভাবে বইমেলা উদ্‌যাপিত হয়েছে, যেভাবে টিএসসি থেকে হুইল চেয়ারে করে প্রবীণ ও শারীরিক অসুবিধাগ্রস্থ মানুষ মেলায় অবাধে প্রবেশ করেছেন- তা মেলার মানবিক দিকটিই স্পষ্ট করেছে। তবে বইমেলার মাসে এসএসসি পরীক্ষা মোটেও সুসংবাদ নয়। কারণ এর মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশ জ্ঞান-ঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভবিষ্যতে বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন এবং আগে-পরের কোনো সুবিধাজনক সময়ে এসএসসি পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন।

এবারের বইমেলায় প্রকাশিত প্রায় পাঁচ হাজার বইয়ের বাণিজ্যিক দিক তো রয়েছেই, পাশাপাশি যাচাই করে দেখতে হবে এদের গুণগত মান। বইয়ের জন্য যেনতেন প্রকারে ফেব্রুয়ারি মাস-ধরা প্রবণতা এখন আমাদের মজ্জাগত। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য এটা কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ নয়। বানান ও বাক্যে নির্ভুল, জ্ঞানগত গভীরতা-নতুনতায় দীপ্ত বইয়ের প্রকাশ নিশ্চিত না করা গেলে বইমেলায় কেবল ভিড়ই বাড়বে, বিপরীত দিক থেকে সমান বেগে হারাবে অন্তর্গত তাৎপর্য।

আমাদের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপ্ত বইমেলা। বিশ্বের কোথাও মাসব্যাপী বইমেলা হওয়ার তথ্য আমাদের কাছে নেই। ইউনেস্কো যেভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী জামদানি ও শীতলপাটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে তেমনি আমাদের বইমেলাও বিশ্বের অবস্তুগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যে মেলাকে ‘প্রাণের মেলা’ বলে অনুভব ও আবাহন করে সে মেলা জাতীয় স্তর পেরিয়ে শীঘ্রই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার বিজয়কেতন নিয়ে পৌঁছে যাবে নিঃসন্দেহে।

 

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়