ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘ভারত সফর হতে পারে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার মিশন’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৮, ৪ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ভারত সফর হতে পারে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার মিশন’

ঠিক ১৪ বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সঙ্গে কাজ করেছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ১৪ বছর পর বিসিবি ছেড়ে নাজমুল আবেদীন ফিরলেন পুরোনো ঠিকানা বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)।

শেষ কয়েক মাসে নিজের কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা না পাওয়ায় বিসিবি থেকে ইস্তফা দেন। সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে ক্রীড়াঙ্গানের আঁতুরঘর। বিকেএসপি টেনে নিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অভিভাবককে। বিকেএসপিতে নাজমুল আবেদীন যোগ দিয়েছেন ক্রিকেট বিভাগের পরামর্শক হিসেবে। কিন্তু মাঠের মানুষ থাকবেন মাঠেই। খুঁজবেন নতুন প্রতিভা। দূর্জয়, রোকনদের পর সাকিব-মুশফিকদের অভিভাবক তিনি। কিন্তু জাতীয় দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স মন ভরাতে পারেনি নাজমুল আবেদীনকে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টের পারফরম্যান্সে অখুশি তিনি।

কোথায় সমস্যা? কেন পারল না বাংলাদেশ? উত্তরণের উপায় কী? ভবিষ্যতে কী করা উচিত? নাজমুল আবেদীন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন রাইজিংবিডিকে:

আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের পারফরম্যান্স যদি মূল্যায়ন করেন। দুই দলের পার্থক্য কোথায় দেখেছেন?

নাজমুল আবেদীন: সবচেয়ে বড় পার্থক্য দুই দলের আত্মবিশ্বাসে। শুরুটা ওখান থেকে। তারপর আমাদের সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্স। শ্রীলঙ্কা সিরিজ এবং বিশ্বকাপের শেষ দিকের পারফরম্যান্স অনেক প্রভাব রেখেছে। আবার নতুন টিম ম্যানেজমেন্ট। রোডসের সময় একটা দর্শন ছিল। একটা নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেখান থেকে ডমিঙ্গো আসলেন। তার নতুন নীতি। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে নতুন একটাতে প্রবেশ করা…ট্রান্সজেকশনের ব্যাপার ছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমি বলব যে, আমরা পিছিয়ে ছিলাম। যেটার ফল মাঠে পেয়েছি।

বাংলাদেশ কি আফগানিস্তানকে খুব হালকাভাবে নিয়েছিল?

নাজমুল আবেদীন: আমার মনে হয় উল্টোটা। আমরা আফগানিস্তানকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিলাম। যেই কারণে আমাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছিল। আমরা ধরেছিলাম আফগানিস্তান আমাদের থেকে ভালো দল। সেই চিন্তা মনের ভেতরে গেঁথে ফেলায় আমরা সেটা নিয়েই মাঠে নেমেছিলাম। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংয়ে সেগুলোর প্রভাব পড়েছে।

চাইলেই তো ম্যাচটা বাঁচানো যেত। টেস্ট ব্যাটিংয়ের যে ধরন, কিছু ক্রিকেটারেরআপনার মোসাদ্দেকের শটটার কথা হয়তো মনে আছে। সাকিবের আউটের কথাই চিন্তা করুন। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে এতটা আগ্রাসন, এতটা তেঁড়েফুড়ে খেলার মানসিকতা কেন?

নাজমুল আবেদীন: আসলে এসব শট হতাশ করবে এটাই স্বাভাবিক। দেখুন, ‘রাইট ফ্রেম অব মাইন্ড’ বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা ঠিক ওই জায়গায় ছিলাম না। যেই জায়গায় থাকলে মানুষ তার সেরা কাজটা করতে পারে। সেখানে থাকা জরুরি। তাতে যেটা হয়, আপনি আপনার সেরা পারফরম্যান্সটা দিতে পারেন। তারপর কী হবে, সেটা তো আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু আপনার ‘মেন্টাল ফ্রেম’ যেন ঠিক থাকে। যেই মানসিক অবস্থায় থেকে আমাদের মাঠে নামার দরকার ছিল, সেটা অমাাদের ছিল না। মানসিকতার ঘাটতি থাকায় আসলে সমস্যা হয়।

মানসিকতা যেহেতু আসলএকটু জানাবেন টেস্ট ম্যাচে মাঠে নামার আগে একটা বড় দলের মানসিকতা কেমন থাকে। ওরা যেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নেয়, বাংলাদেশ সেই প্রস্তুতিটা নিতে পারে না কেন?

নাজমুল আবেদীন: আমাদের সমস্যা হলো, এখানে প্রচুর বাইরের বিষয় কাজ করে। একটা দল মানে শুধু এখানে একটা দল নয়। কিংবা দলের কোচ নয়। সংস্কৃতির কারণে আমাদের খেলোয়াড়রা বাইরের বিষয়ের ওপর অনেক প্রভাবিত হয়। মিডিয়া হোক, বাইরের লোকজন হোক কিংবা বাইরের ক্রিকেটের লোকজন হোক…বোর্ড বা বোর্ডের ম্যানেজমেন্ট হোক; আমাদের ছেলেরা এসব দিক থেকে খুব প্রভাবিত হয়। বাইরের প্রভাবগুলো যদি ইতিবাচক থাকে সেটা তাদের সাহায্য করে। কিন্তু প্রভাবগুলো যদি নেতিবাচক হয় সেটা তাদের আরেকভাবে ক্ষতি করে। ওখানে একটা গ্যাপ হয়ে যায়। তখন মানসিকভাবে আমরা শক্ত অবস্থায় থাকি না, বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে এটা হয়।

মনের ভয় আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। মনের ভয় তো দূর হয় তখনই যখন ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলবে একই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, আবার ওই সময়ে পারফর্ম করবে। কিন্তু আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অধিনায়ক সাকিব

নাজমুল আবেদীন: তা তো বটেই…ঘরোয়া ক্রিকেটে আমরা একটা খেলোয়াড়কে কীভাবে মার্ক করি, কেউ ১০০ তে ৪০ পেল তাকে আমরা গ্রুম করে খেলানোর পর্যায়ে নিয়ে যাই। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১০০ তে ৪০ দিয়ে হবে না। ওখানে ১০০ তে ৯০ পেতে হবে। এখানে বিশাল দূরত্ব। এই যে, ৪০ ও ৯০ এর মধ্যে যে দূরত্ব, সেটার একটা প্রভাব থাকবে। আমরা যারা খেলোয়াড়কে প্রস্তুত করি তারা যদি মনে করি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে এই দূরত্ব নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করা যাবে তাহলে বড্ড ভুল হবে। ওই জায়গাটায় আমাদের বিরাট কাজ করার আছে। এই দূরত্বটা আমাদের কমাতেই হবে।

আমরা বড় দলগুলোর বিপক্ষে ভয়ডরহীন খেলব আর আমাদের থেকে পিছিয়ে আছে কিংবা সমমানের তাদের বিপক্ষে খানিকটা গুটিয়ে রাখব; আমাদের ক্রিকেটারদের কি এসব মানসিকতা কাজ করে?

নাজমুল আবেদীন: আমাদের দল বলতে যদি বুঝাই তাহলে পুরো দলের ওপর দায়টা পড়বে। আমি কিছু কিছু খেলোয়াড়ের কথা বলব যারা এগুলো চিন্তা করে। সমস্যা হয় কী, খেলোয়াড়ের আশেপাশে যারা থাকে তাদের অনেকের মধ্যে এ জিনিসটা থাকে এবং সমপর্যায়ের কিংবা একটু কম শক্তির দলের বিপক্ষে খেলি, তখন হার-জিতে আমাদের ফোকাস হয়ে যায়। তখন আমরা প্রসেসগুলো ঠিক রাখতে পারি না। ছোট ছোট কাজগুলো যদি ঠিকঠাক মতো করতে পারি তখন কাজগুলো সহজ হয়ে যায়। কিন্তু খেলার আগে চিন্তা আসে হারলে কী হবে! তখন ভয়টা আরো বেড়ে যায়। তখন আসলে ভালো খেলা সম্ভব হয় না। চাপ অনেক অনেক গুণ বেড়ে যায়। খুব কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয় ওই সময়।

টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আলাদা স্কোয়াড করার বিলাসিতা কি বাংলাদেশ করতে পারে এই মুহূর্তে?

নাজমুল আবেদীন: ঠিক এই মুহূর্তে নয়। আমাদের পরবর্তীতে এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেই হবে। যদি আমরা এটা করতে চাই তাহলে জাতীয় দল নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। আমাদেরকে জাতীয় দলের ঠিক আগের ধাপে যেমন ‘এ’ দল, এইচপি দল বা ইমার্জিং দল নিয়ে কাজ করতে হবে। ওদেরকে আমাদের টেস্টের জন্য তৈরি করতে হবে। ওদের নিয়ে আমাদের ভাবনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। কাদেরকে আমরা টেস্টে নেব, কাদেরকে আমরা ওয়ানডেতে বা টি-টোয়েন্টিতে দেখতে চাই। ওখান থেকেই যদি আমরা তাদেরকে আলাদা করে ফেলতে পারি এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেওয়া শুরু করতে পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আলাদা আলাদা দল গড়া সম্ভভ হবে। দলে অবশ্যই মিল থাকবে কিন্তু এক ফরম্যাটের সঙ্গে অন্য ফরম্যাটের পাঁচ-সাত জনের ডিফারেন্স থাকলেও থাকতে পারে। সেই সম্ভাবনা আমাদেরকে তৈরি করতে হবে। তবে এ মুহূর্তে একেবারেই তা করা ঠিক হবে না।

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কী মনে হচ্ছে দল কেমন করতে পারে?

নাজমুল আবেদীন: খুব চ্যালেঞ্জিং হবে এটা বলা বাহুল্য। আমরা খুব ভালো একটা অবস্থান থেকে যাচ্ছি না। আমাদের সাম্প্রতিক সময়ের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ভালো না। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। আবার আমরা জানি যে ভারত টেস্টে আমাদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। আমরা যদি ফ্রি খেলতে পারি, ইতিবাচক মনোভাব থাকে তাহলে আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেট খেলতে পারব। আমাদের সেরা ক্রিকেট খেলা মানেই টাফ ফাইট দেওয়া। যদি সেরা ক্রিকেট খেলতে পারি তাহলে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাব। ভারত সফরের দুটি টেস্ট নিয়েই আমাদের চিন্তা করলে হবে না। আমাদের সামনে আরো টেস্ট ম্যাচ আছে। যদি ভারত সিরিজের আত্মবিশ্বাস আমরা পরবর্তীতে কাজে লাগাই, যদি সেটাকে বেঞ্চ মার্ক হিসেবে কাউন্ট করি তাহলে আমরা সামনে ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারব। এখান থেকে আমাদের পাওয়ার অনেক কিছু আছে। যদি আমরা সেসব পেয়ে যাই তাহলে আমাদেরকে পরবর্তীতে ছন্দে ফিরিয়ে আনতে অনেক সাহায্য করবে।

 

ঢাকা/ইয়াসিন/পরাগ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়