ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ভিয়েতনামের পথে: ১৯তম পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ২১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিয়েতনামের পথে: ১৯তম পর্ব

ফেরদৌস জামান : ওয়াট মে ইয়েনের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে একই পথে অনেকটা পেছন দিকে আসতে হলো। পথের এক পর্যায়ে তিন মাথায় এসে একটা শাখা পথ খানিকটা উপরের দিকে উঠে গেছে। এই পথ দিয়েই আমাদের যেতে হবে মে ইয়েন ঝরনায়। থাইল্যান্ড এসে এটা হতে যাচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় ঝরনা দর্শন। ধান ক্ষেতের মাঝখান দিযে পাকা রাস্তা। রাস্তার সাথে পাড় বাঁধাই করা সরু খাল দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে আসছে। কোথা থেকে আসছে তা অজানা। রাস্তাটা যেভাবে এগিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে শেষ হয়েছে ঐ পাহাড়ে গিয়ে। তার আগে ডানে-বাঁয়ে দু’একটা উপ-শাখা ছাড়িয়ে গেছে। দু’পাশে অনেক খালি জায়গা নিয়ে অতি সুন্দর একেকটা রিসোর্ট। হাঁটতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। ধান ক্ষেতের দোল দেয়া বাতাসে পোলাও পোলাও সুগন্ধ ম ম করছে। পেট ভরে দীর্ঘ একেকটা শ্বাস নিতে নিতে শরীর যেন একটু আশকারা পেয়ে বসল- সব বাদ দিয়ে সারাদিন আইল ধরে হাঁটলে মন্দ হয় না।

এমন যখন ভাবছি হঠাৎ পশ্চিমা এক বৃদ্ধ দম্পতি এসে সামনে দাঁড়াল। বৃদ্ধ বললে ভুল হয় এরাই আসলে প্রকৃত তরুণ, যদি বয়সে নয় স্পৃহা আর উদ্যমে তারুণ্যের পরিমাপ করা হয়। চোখেমুখে তাদের পূর্ণ পরিতৃপ্তির ছাপ। কত না কত কিছু দেখেছে তার তৃপ্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ এখনও সজীব। হাসি মুখে হাই বলে কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইল। আমাদের লক্ষের কথা জানার পর প্রথমে সাধুবাদ জানালেন। অতঃপর নিজ থেকেই জানিয়ে দিলেন পরবর্তী পথের বিস্তারিত। সময় পেলেই তারা থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত এই জায়গা পাই উড়ে আসেন। তাদের মে ইয়েন ঝরনায় যাওয়া হয়েছে তিন তিনবার! সে হিসেবে এমন দক্ষ পথ প্রদর্শক পেয়ে আমরা আনন্দিত এবং ধন্য। সাথে আরও জানিয়ে দিলেন, এখান থেকে কিছুটা পথ এগোলেই জনগোষ্ঠী-কারেন বসতি মিলে যাবে, আর সেটা যেন পরিদর্শন করতে না ভুলি। হাতের ঘরিটাতে সময় দেখে যাতায়াতে কতক্ষণ লাগতে পারে সে হিসেবটাও কষে দিলেন। সদা হাস্যজ্জল পথ প্রদর্শকদ্বয়কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলাম।



এবার মনে অনেকটা বল পেলাম। একই সাথে ভরসা। পাকা রাস্তার শেষ মাথায় খালের উপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে একটু এগোলেই কারেন বসতি। মরা কাঠের গুল দিয়ে বানানো সাইনবোর্ড। তাতে যা লেখা আছে তা নিশ্চয়ই বসতির নামটাই হয়ে থাকবে। কুড়িয়ে নেয়া উপকরণে তৈরি অতি সাধারণ সাইনবোর্ড। বোর্ডের খুঁটি বেয়ে উঠেছে লতা জাতীয় গাছ। আশপাশে গাছে ধরে আছে পেঁপে। দু’একটায় কেবল সিঁদুর লেগেছে। এমন ডাগর পেঁপে দেখে লোভ সামলানো বড়ই কঠিন। কোন সাড়াশব্দ নেই। যে কোন বসতি মানে শিশু-কিশোরদের চঞ্চল চলাফেরা বা দৌড়াদৌড়ি থাকবে। থাকবে গৃহপালিত পশুপাখিরর আনাগোনা কিন্তু এই জায়গা শুনশান নীরবতায় ঘেরা। আমাদের দেখে একজন নারী এগিয়ে এলেন। এগিয়ে আসা দেখেই বোঝা যায় জানতে চাইবেন আমাদের উদ্দেশ্য। আমরাও প্রস্তুত। তার পোশাক সাধারণ, গলায় পেঁচানো স্বর্ণের মতো চকচকে বস্তুটি নেই। ভাবনা পরিবর্তন করে ধরে নিলাম কারেন বসতি বোধহয় আরও একটু দূরে হবে। এমন ভাবনার এক পর্যায়ে তার আচরণে বুঝতে পারলাম ভেতরে প্রবেশের জন্য আগে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এটা তো অপ্রত্যাশিত! মনে পড়ে গেল মে হং সনে পরিচয় হওয়া সেই সুইডিশ স্কুল শিক্ষকের কথা। মে হং সনের কারেন বসতি ভ্রমণের ক্ষেত্রে যে এরূপ পরিস্থিতি হয়ে থাকে সে বিষয়টি অবহিত করে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এরূপ কৃত্রিম আয়োজন দেখার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই। তাও আবার জনপ্রতি একশ বাথ প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে।



ভেতরে জাদুঘর জাতীয় আয়োজন ছাড়া তেমন কিছুই পাবার সম্ভাবনা নেই। আমি তো দেখতে চাই তাদের জীবন, বিশ্বাস, খাদ্য। এমনকি সম্ভব হলে সাথে বসে এক বেলা খাওয়া। প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে কোন টিকিটের ব্যবস্থা নেই। এটা অব্যবস্থাপনা হিসেবে গন্য হতে পারে। যেহেতু টিকিট নেই তাহলে দরদাম করায় কোনো ইতস্তত বোধ হবারও কারণ নেই। মহিলাটি ভেতরে ফোন করলেন এবং কথা শেষে বললেন, একশ করেই দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে প্রবেশ মূল্য পরিশোধ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সেগুন পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি একটা চালের নিচে কয়েকটা ডালা, টুকরী, মাথাল জাতীয় নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র সাজানো। তারপর উঠান। উঠানের দুই পাশে দুইটা কাঠ-বাঁশের ঘর। সম্মুখে দুই-তিনটা দোকান। এই সমস্ত কিছু ঘিরে বেশ কিছু গাছপালার সৌন্দর্য এবং পেছন দিকে সবুজে ঢাকা টিলা এগিয়ে গেছে পাহাড় সারির নিচে। বসে আছে তিনজন তরুণী। শরীরে ঐতিহ্যবাহী পোশাক। প্রত্যেকের গলায় চকচকে ধাতব তার পেঁচানো। তারা বসতির অধিবাসী, বিক্রেতা এবং একই সাথে প্রদর্শিত পণ্য। দোকানে রয়েছে স্থানীয় হস্তশিল্পজাত কিছু জিনিসপত্র। দামে চূড়ান্ত রকম বেশি।



পরবর্তী সময়ে আর পাওয়া যাবে কি না এই ভেবে দুএকটা পছন্দ হওয়ায় কিনতে বাধ্য হলাম। সর্বপ্রথম দোকানে বসা তরুণীটির নাম মো ফা ও। ইংরেজিতে সে শুধু জিনিসগুলোর দামটাই বলতে পারে এবং কেউ জানতে চাইলে নিজের নামটা। এর অধিক একটি শব্দও উচ্চারণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। পাশের দোকানে অন্যজন বসে দোকানদারী এবং তাঁতে কাপড় বোনা দুই কাজ করছে। তার পাশের দোকানের তরুণী শুধু হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে। গলায় তিনজনেরই ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কার, যে জিনিস পরিহিত মানুষ দেখতে প্রবেশ মূল্য দিয়ে তিন ঘরের এই বসতিতে ঢুকেছি। বিশেষ এই অলঙ্কারে সজ্জিত মেয়েদের গলা যত বেশি লম্বা হবে ততো বেশি সৌন্দর্য। কিন্তু এই তিনজনের কারোরই গলা সে পরিমান লম্বা হয়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে দুচারটা কথা বলব, সে উপায় একেবারেই নেই। তিনজনকে চিড়িয়াখানার কোন জন্তুর চেয়ে অধিক কিছু মনে হলো না। হতে পারে কোন ব্যবসায়ী এদের এখানে এনেছে। অথবা তারা স্বউদ্যোগে এসেছে। অথবা অনেক দিন এখানেই আছে, বর্তমানে অন্য কারও পৃষ্ঠপোষকতায় এই অবস্থা। পৃথিবীর বর্তমান বস্তবতাটা এখন এমনই, মানুষ তো দূরের বিষয়, মানুষের আনন্দ-বেদনা, আবেগ, বিশ্বাস সবই এখন পণ্য। এমনকি মানুষের গু পর্যন্ত এর অন্তর্ভূক্ত। এই পণ্য পরিণতির পৃথিবীতে আমার মতো পর্যটকদের জন্য কারেন বসতি নামের এই জায়গায় কৃত্রিম আয়োজন খারাপ কিছু নয়। আমাদের ঘারের উপর যে মাথা আর তার মধ্যে যে মস্তিষ্ক; তা কেবল আমরা বয়ে বেড়াই। প্রকৃতপক্ষে তার নিয়ন্ত্রণ এই পণ্যবাজ অধিকর্তা মহলের হাতের মধ্যে। অতএব, এই বসতি যদি কৃত্রিম উপায়েও হয়ে থাকে তবু পরিতৃপ্তির ঢোক গিলে বলতে হবে- নতুন কিছু দেখলাম!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৮/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়