ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মনের অতল তলের খোঁজ দেওয়া এক শিল্পী

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মনের অতল তলের খোঁজ দেওয়া এক শিল্পী

সত্যজিৎ রায়

রুহুল আমিন : ‘পথের পাঁচালি করার পরে এই পঁচিশ বছরে আমি চলচ্চিত্র শিল্প বিষয়ে নতুন কী জ্ঞান লাভ করেছি এবং সেটা কীভাবে আমার পরবর্তীকালের সিনেমাতে প্রতিফলিত হয়েছে, সে কথা আমাকে অনেকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করেছিল।  এই প্রশ্নের পেছনে হয়ত  এমনো একটা ইঙ্গিত ছিল যে, পথের পাঁচালির মতো এত খ্যাতি, এত প্রশংসা,  এত পুরস্কার যখন আমার আর কোনো সিনেমাই পায়নি, তখন চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যিই কি এই পঁচিশ বছরে আমার কোনো উন্নতি হয়েছে? এর এক কথায় উত্তর হলো- হুম, অবশ্যই হয়েছে। তার প্রমাণ আছে আমার পরের দিকের অনেক সিনেমাতেই।’

(সত্যজিৎ রায় :  বিষয় চলচ্চিত্র, পৃষ্ঠা নং ১২৪)

চিত্রশিল্পী, সংগীত, প্রচারবিদ, বাগ্মী, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই সমান দক্ষ লেখক সত্যজিৎ রায়। তারপরও তার প্রধান পরিচয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুক্তিদাতা তিনি। তার চলচ্চিত্র ভারতীয় সংস্কৃতি-সরণীর এক একটি মাইলস্টোন, আর বিশ্বের মানচিত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্রের উত্থানের পুরোধা ব্যক্তি। শিল্পকলার প্রায় সব শাখাতেই যার সফল পদচারণা ছিল।  সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক ও সংগীতে সত্যজিৎ রায় বিখ্যাত এক শিল্পী। বাংলা চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা সৃষ্টিতে সত্যজিৎ রায় ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। জন্মের মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে বড় করে তোলেন। সত্যজিৎ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শুরু করেন। যদিও চারুকলার প্রতি ছিল তার গভীর দুর্বলতা। ১৯৪০ সালে মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি।

বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা শেষে সত্যজিৎ কলকাতায় চলে আসেন। পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা  ‘ডি জে কিমার’-এ জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালের দিকে তিনি প্রকাশনা সংস্থা ‘সিগনেট প্রেস’ এর সঙ্গে জড়িত হন। এই প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকাই ছিল তার কাজ।

সত্যজিৎ রায় একাধারে  চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, সংগীতজ্ঞ, চলচ্চিত্র সমালোচক, লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, চিত্রকর ও আলোকচিত্রী। অমর এই শিল্পী সেলুলয়েডে এঁকেছেন মানুষের জীবনের নানামুখি উত্থান পতনের ছবি। গল্প বলার ছলে তিনি বলেছেন মানুষের আবেগ, অনুভূতি, কাব্যময়তা, অসহায়ত্ব, মানবিকতা, মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা বেদনার কথা। তার কাছে ক্যামেরা যেন ছিল রঙ তুলি। আর তা দিয়ে তিনি এঁকেছেন জীবনের বহুমুখি ছবি। জীবনকে দেখেছেন অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে। খোঁজ দিয়েছেন মানব মনের অতল তলের। সিগনেট প্রেস থেকে বের হওয়া প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন তিনি। আর বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র শিশুতোষ সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ এই প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল। বইটির প্রচ্ছদ আঁকার দায়িত্ব পড়ে সত্যজিতের উপর। প্রচ্ছদ আঁকার আগে উপন্যাসটি পড়েন তিনি। উপন্যাসটি সত্যজিৎকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে সত্যজিত রায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় ‘পথের পাঁচালী’ বেছে নেন।

১৯৪৭ সালে অন্যদের সঙ্গে মিলে তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ম সোসাইটি। সোসাইটির কল্যাণে বিশ্বের বহু বিখ্যাত ছবি দেখেন। তবে ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া ইতালির পরিচালক ভিট্টোরিয় ডি সিকার অমর চলচ্চিত্র 'বাইসাইকেল থিফ' দ্বারা চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হন। পরে তিনি ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৫২ সালের শেষ দিকে নিজের জমানো টাকায় ‘পথের পাঁচালী’সিনেমার দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে সিনেমাটির নির্মাণ শেষ করেন এবং  একই বছর সিনেমাটি মুক্তি পায়।

মুক্তির পর পরই সিনেমাটি দর্শক-সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা পায়। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্টারি’ক্যাটাগরিতে সিনেমাটি পুরস্কৃত হয়। এ ছাড়াও ১১টি আর্ন্তজাতিক পুরস্কার পায় সিনেমাটি। এই সিনেমার মাধ্যমেই চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ পথচলার শুরু হয়। আর পরবর্তী ‘অপরাজিত’ তাকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। এটি ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জিতে।

এরপর তিনি একে একে নিমার্ণ করেন  ‘অপুর সংসার’, ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘চারুলতা’, ‘দেবী’, ‘মহানগর’, ‘অভিযান’, ‘কাপুরুষ’, ‘মহাপুরুষ’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘জনারণ্য’, ‘হীরক রাজার দেশ’, ‘গণশত্রু’, ‘আগন্তুক’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ও  ‘আগুন্তক’। আর ডকুমেন্টারি ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম, ফিচার ফিল্মসহ সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭ টি সিনেমা।

সেলুলয়েডে আলোছায়ার ব্যঞ্জনায় উপন্যাসের কাহিনি ও পরিবেশ বর্ণনা, দ্বন্দ্ব, সুরের  ছন্দকে খুব সাবলীলভাবে সাজাতেন তিনি। অমর এই সিনেমা কবির চলচ্চিত্র ছিল মূল প্লাটফর্ম।

শিল্প-সাহিত্যের অন্য সব শাখায় ছিল সফল পদচারণা। যেখানে হাত দিয়েছেন দুহাতে মুক্তো ফলেছেন। লিখেছেন ছোটগল্প। চলচ্চিত্র নিয়েও লিখেছেন  ‘আওয়ার ফিল্মস’, ‘দেয়ার ফিল্মস’, ‘বিষয়: চলচ্চিত্র’ ও ‘একেই বলে শুটিং’।  নিজের লেখা সব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভেতরের ছবি তিনি নিজেই একেঁছেন।

১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমার কাজ করার সময় সত্যজিৎ রায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে কাজের গতি কমে যায়। এরপর থেকে প্রায়ই তিনি অসুস্থ থাকতেন। ১৯৯২ সালে আবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি পেন্সিলে আঁকেন একটি গাছের স্কেচ। যার মধ্যে ছিল উপমহাদেশের ১১জন বিখ্যাত মনীষীর মুখাবয়ব।

১৯৯২ সালে মৃত্যুর মাত্র একসপ্তাহ আগে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সন্মানজনক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান সত্যজিৎ রায়। একই বছর ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করে। এ ছাড়াও জীবদ্দশায় তিনি ৩২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন।  দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি। আর  ১৯৮৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান।

বাংলা বা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব-চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৭/রুহুল/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়