ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মহাশ্বেতা দেবী স্মরণে

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ২৮ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহাশ্বেতা দেবী স্মরণে

রুহুল আমিন : মহাশ্বেতা দেবী  ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলোর (বিশেষত লোধা ও শবর উপজাতি) অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছেন।

২০১৬ সালের আজকের এই দিনে (২৮ জুলাই) কলকাতার বেল ভিউ ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এর আগে ২৩ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ক্লিনিকে ভর্তি হন। পরে ২৮ জুলাই একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে তার মৃত্যু হয়। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে রইল গ্রভীর শ্রদ্ধা।

১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায় মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম। বাবা মণীষ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। মণীষ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তার ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন ‘দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।

ঢাকাতেই মহাশ্বেতা দেবীর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু। দেশ ভাগের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। এরপর তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

১৯৬৪ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় কলেজে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত) শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই সময় বিজয়গড় কলেজ ছিল শ্রমিক শ্রেণির ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময় মহাশ্বেতা দেবী নিজেকে সাংবাদিক ও সৃজনশীল লেখক হিসেবে পরিচিত করে তোলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার প্রসারিত কথাসাহিত্যে তিনি প্রায়শই ক্ষমতাশালী জমিদার, মহাজন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে উপজাতি ও অস্পৃশ্য সমাজের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র অঙ্কন করেছেন।

১৯৪৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেন। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পথপ্রদর্শক। ১৯৪৮ সালে তাদের ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। নবারুণ পরবর্তীকালে ঔপন্যাসিক ও রাজনৈতিক সমালোচক হয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী একটি ডাকঘরে চাকরিও করেছেন কিছুদিন। কিন্তু কমিউনিস্ট মনোভাবের জন্য তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য সাবান বিক্রয় এবং নিরক্ষরদের জন্য ইংরেজিতে চিঠি লিখে দেওয়ার মতো কাজও করেন। এরপর তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৬২ সালে তিনি অসিত গুপ্তকে বিয়ে করেন।

মহাশ্বেতা দেবী বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তি শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহীত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। এই বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি অবলম্বনেই ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।

মহাশ্বেতা দেবী পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী)-নেতৃত্বাধীন সরকারের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশেষত তিনি কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে তা অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে শিল্পপতিদের দিয়ে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন। এই নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সিপিআই(এম)-এর ৩৪ বছরব্যাপী শাসনকালের অবসান ঘটেছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতা করেছিলেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক ও নাট্যকর্মীকে একত্রিত করেন।

মহাশ্বেতা দেবী ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টিরও বেশি ছোটগল্প রচনা করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঝাঁসির রানি’ (লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনীগ্রন্থ)। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। এই উপন্যাসটি রচনার আগে তিনি ঝাঁসি অঞ্চলে গিয়ে তার রচনার উপাদান হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য ও লোকগীতি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, পদ্মবিভূষণ, সার্ক সাহিত্য পুরস্কার, যশবন্তরাও চবন জাতীয় পুরস্কার ও বঙ্গবিভূষণ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৭/রুহুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়