মাকে কেউ দেখেন স্বর্ণালি কেউ কালো।। এ কে আজাদ
মা ভবানীর মন্দির প্রাঙ্গণ
মা ভবানীর মন্দির ঐতিহাসিক মন্দির হিসেবে পরিচিত। উপমহাদেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ৫১টি পীঠস্থানের মধ্যে এটি অন্যতম। প্রতিবছর দেশি-বিদেশি পুণ্যার্থী ও ভক্তকুলের আগমন ঘটে এখানে।
বিশেষ করে মাঘী পূর্ণিমা ও রাম নবমী উৎসব ঘিরে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান থেকে লাখো পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটে মা ভবানীর মন্দির প্রাঙ্গণে। দেশের এই দর্শনীয় স্থানটি শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি।
কালিকাপুরাণ অনুসারে দক্ষযজ্ঞে দেবী সতী স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। সতীর প্রাণহীন দেহ নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। ওই মহাপ্রলয় নৃত্য থেকে বিশ্বব্রহ্মা- রক্ষাকল্পে স্বয়ম্ভু বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে সতীর প্রাণহীন দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত করেন। সেসব দেহখণ্ড বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পতিত হলে পীঠস্থানের উদ্ভব হয়।
ভবানী দেবীর বামপাজরাস্থি মতান্তরে দক্ষিণ চক্ষু পতিত হয়েছিল। এই পীঠস্থানে দেবীর নাম অর্পণা (ভবানী) এবং বামন ভৈরব। প্রাচীন এই মহাতীর্থ ক্ষেত্রের বর্তমান মন্দির অবকাঠামো নাটোরের মহীয়সী রানী ভবানী কর্তৃক অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত নাটোর এস্টেট থেকে মন্দিরের যাবতীয় ব্যয় বহন করত। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর সরকার নাটোরের ছোট তরফ এস্টেট অধিগ্রহণ করে। দেবোত্তর এই মন্দিরের ব্যয় বহনের জন্য অ্যানুয়িটি নির্ধারণ করেন।
নাটোরের রানী ভবানী এস্টেট কর্তৃক দেবোত্তরের ১২ বিঘা জমির ওপর এই মন্দিরের অবকাঠামো নির্মিত। চারদিকে প্রাচীরবেষ্টিত মন্দির চত্বরে রয়েছে দক্ষিণমুখী মূল মন্দির।
বামেশ ভৈরব শিবমন্দির, অপর তিনটি শিবমন্দির, ভোগ পাকশালা নাথমন্দির, দুটি অতিথিশালা, বাসুদেব মন্দির, গোপাল মন্দির নর নারায়ণ সেবাঙ্গন, পাশেই শাখারি পুকুর, দুটি স্নানঘাট। প্রাচীর বেষ্টনীর বাইরে তিনটি শিবমন্দির এবং একটি পঞ্চমুণ্ড আসন রয়েছে।
মা ভবানী মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক নিমাই ঘোষ এবং কেয়ারটেকার অমলীয় চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মা ভবানী মন্দিরের আদি ইতিহাস এবং মন্দিরের সম্পত্তি বেহাত হওয়ার তথ্য। এ ছাড়া শেরপুরের ইতিহাস বইটির লেখক রোস্তম আলীর সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে মা ভবানী মন্দিরের বেহাল কাহিনি।
তারা রাইজিংবিডিকে জানান, মা ভবানী মন্দিরের নামে ব্রিটিশ আমলের সিএস রেকর্ডভুক্ত শত শত একর জমি বেদখল রয়েছে। নাটোরের রানী ভবানী ছোট তরফ এস্টেট এবং অন্যান্য জমিদারের পক্ষ থেকে এই মন্দিরে অনেক ভূসম্পত্তি দান করা হয়েছিল। এ ছাড়াও ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর তৎকালীন সরকার শ্রীশ্রী ভবানীমাতা ঠাকুর রানী এবং অন্যান্য মন্দিরের নামে ১৮৬ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
এই সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাজশাহী বিভাগীয় রাজস্ব কর্মকর্তাকে।
মন্দিরের এত ভূসম্পত্তি থাকলেও পরবর্তী সময়ে মন্দিরের নামে বরাদ্দ ভূসম্পত্তি ও জলমহাল ভুলবশত সরকারি খাস খতিয়ান হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়। বর্তমানে এই জমি উদ্ধারে আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
মা ভবানী মন্দিরের কেয়ারটেকার অমলীয় চন্দ্র চক্রবর্তী রাইজিংবিডিকে জানান, এ পর্যন্ত ১০-১২টি মামলার রায় মন্দিরের পক্ষেই এসেছে। তবে মামলাগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ফলে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি সহায়তা ছাড়া এই মন্দিরের সম্পদ উদ্ধার করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। সরকার চাইলে প্রচীন এই মন্দিরকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। এতে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।’
বগুড়ার সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভবানীপুর ইউনিয়নে এই প্রাচীন মন্দিরটি অবস্থিত। এখানে প্রতিবছর দুর্গাপূজা হয়। কথিত আছে মন্দিরে অবস্থিত দেবী মায়ের রূপ একেক জনের কাছে একেক রকমভাবে ধরা পড়ে। কেউ দেখেন স্বর্ণালি আবার কেউ দেখেন কালো।
রাইজিংবিডি/বগুড়া/১৯ অক্টোবর ২০১৫/একে আজাদ/রণজিৎ/শাহনেওয়াজ/এএন
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন