ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ইলিশকাল- প্রথম পর্ব

মাছের রাজার দখলে মাছ বাজার

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাছের রাজার দখলে মাছ বাজার

রফিকুল ইসলাম মন্টু: কই গেলা? ঘরের কাছে এসে রহমতউল্লাহ’র হাঁক। পরনের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। উদোম শরীর। লবণে পুড়ে তামাটে বর্ণ। মাথায় পেঁচানো লাল চেক প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া গামছাটা। হাতে ঝুলছে রশি বাঁধা একজোড়া বড় ইলিশ। মাথায় আরেকটা বোঝা। খররোদে অনেকদূর হেঁটে এসেছেন বলে ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। প্রায় সপ্তাহখানেক পর ঘরে এসে দেখে ঘর শূন্য। ছেলেপেলে একটাও নেই; বউটা কোথায় গেছে কে জানে! হয়তো পাশের বাড়ি। রহমতউল্লাহর আবার হাঁক- কই গেলা, শুনছ?

এরই মধ্যে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে এসে ঢোকে মিনারা। ইলিশ দুটো ঘরের মেঝেতে রাখে রহমতুল্লাহ। ঘরে দুটো বড় সাইজের ইলিশ এসেছে- এ যেন পরম পাওয়া; এক আনন্দের দিন। শুধু তো ইলিশ নয়, রহমতুল্লাহ মাছঘাট থেকে আসার পথে নিয়ে এসেছে চালডাল, আর কিছু সদাইপাতি। সঙ্গে আছে ছেলেমেয়ের জন্য বিস্কুট, চকলেটের প্যাকেট। মিনারার মনে আনন্দ ধরে না। ছেলেমেয়ের ডাকে- রুবেল, শেফালি তোরা গেলি কই?

রহমতুল্লাহর বাড়ি চরফ্যাসনের সামরাজ। এখানে আছে বড় মাছঘাট। আছে বাজার। বাজারের পাশে ছোট্ট ঝুপড়িতেই থাকে। পেশায় জেলে। ইলিশ মৌসুম যেন ওদের পরিবারে ঈদের মৌসুম। সারা বছর নানান রকম নিষেধাজ্ঞায় মাছ ধরায় বাধা পড়ে। এখন রহমতুল্লাহ একেবারেই মুক্ত। ঘরের খুঁটিনাটি কাজকর্ম, ধারদেনা শোধ, ছেলেমেয়ের আবদার পূরণ, সাধ করে স্ত্রীর জন্য দু’খানা শাড়ি কেনার সময় এটাই। রহমতুল্লাহ সব জমিয়ে রাখেন এই সময়ের জন্য। মনে মনে অনেক ছক আঁকেন; এবারের ইলিশ মৌসুম এলে এটা করবেন, ওটা করবেন। শুধু রহমতুল্লাহ নয়, উপকূলের হাজারো জেলের জীবন এমনই। সবার অপেক্ষা এই ইলিশ মৌসুমের জন্য। এই সময়টাতে কখনো ইলিশ মেলে; আবার কখনো মেলে না। তবুও অপেক্ষার আশা শেষ হয় না। আশায় বুক বেঁধে মাছ ধরার সব প্রস্তুতি। আড়তদার, দাদনদারের কাছে বাঁধা পড়া, দোকানে-মহাজনের কাছে দেনায় বন্দি হওয়া- এসবের পর ইলিশ মৌসুমেই যেন জেলেদের মুক্তি।

 

 

ঊষাকাল পেরিয়ে তখন ভোর। আলো ফুটেছে। পুব আকাশ সূর্যটা খানিক দূর উঠে গেছে। বাড়ছে রোদের তেজ। এরইমধ্যে মেঘনাতীরের দৌলতখানের চৌকিঘাটের ব্যস্ততা বেড়েছে। সবার কাছে অতিপরিচিত এ মাছঘাট। ঘাটে ভিড়েছে নৌকা। ঝুড়িভর্তি মাছ উঠছে আড়তে। তার আগে ইলিশ বাক্সে। হাঁকা হচ্ছে দর। মুহূর্তে বেচাকেনা শেষ। মাছের গন্তব্য আড়তদারের আইসবাক্স। এখান থেকে মাছ যাবে বড় আড়তে। বড়-ছোট সব সাইজের ইলিশ বড় শহরের বড় বাজারে ক্রেতাদের সামনে ওঠার জন্য যাত্রা করে। সেখানে তো আবার শহুরে ক্রেতারা অপেক্ষা করছেন কাঙ্ক্ষিত ইলিশের। বহু প্রতীক্ষিত ইলিশকে ঘিরে ঘাটে ঘাটে টাকা। মাঝি-জেলের মাছধরায় যে বিনিয়োগ আড়তদারের করেন, তা ইলিশ ঘাটে ওঠামাত্রই উসুল করে নেন। এরপর বড় আড়তদার, তার বড় আড়তদার- সকলেই নিজেদের বিনিয়োগটা তুলে নেন সঙ্গে সঙ্গে। একইসঙ্গে টাকার অঙ্কে ইলিশের দামও বাড়তে থাকে।

এখন সময় ইলিশের। অন্য সময় থেকে পুরোপুরি আলাদা। ইলিশের ধাক্কায় অন্য মাছের দাপটও যেন কম। গ্রাহকের চাহিদার তালিকায়ও এক নম্বরে ইলিশ। মার্চ এপ্রিলে যে ইলিশ ছোঁয়া নিষেধ, অক্টোবর-নভেম্বরের বড় অংশ জুড়েও যেখানে ইলিশ ছুঁয়ে দেখাও নিষেধ- সেখানে এখন সময় পুরোপুরি উল্টো। নেই নিষেধাজ্ঞা, নেই অবরোধ। ব্যস্ত সময় মাছঘাটে, মাছ বাজারে। শুধু যে ইলিশ ধরা, কিংবা ইলিশ বেচাকেনার সঙ্গে জড়িতরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তা নয়। এই ইলিশ মৌসুম উপকূলের এক একটা মাছঘাট, এক একটা হাট-বাজারকে জীবন্ত করে তোলে। টেইলারিং দোকান, খাবারের হোটেল, খুচরো যন্ত্রাংশের দোকান, ওয়ার্কশপ, এমনকি চায়ের দোকান, মুদি-মনোহরির দোকানও যেন এসময় প্রাণ ফিরে পায়। দ্বীপ জেলা ভোলার প্রায় সবগুলো উপজেলা মেঘনা তীরবর্তী হওয়ায় এখানে মাছঘাট ও জেলের সংখ্যা অনেক বেশি। ভোলা সদরের ইলিশা ঘাট, চডার মাথা মাছঘাট, কাছিয়া মাছঘাট, তুলাতলী মাছঘাট, নাছির মাঝি মাছঘাট, দৌলতখানের চৌকিঘাট, ভবানীপুর, সৈয়দপুর, চরফ্যাসনের বেতুয়া, সামরাজ, কুকরির মনুরা, ঢালচরের হাওলাদার বাজার, লক্ষ্মীপুরের মতিরহাট, লুধুয়া, আলেকজান্ডার, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের টাংকিঘাট- এ তালিকা হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ। উপকূলের সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী এইসব ঘাটগুলো যেন ইলিশ মৌসুমের এই সময় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়। ইলিশ মৌসুম আসার আগে অন্য সময়ে এইসব ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, মাছঘাটগুলো একেবারেই নিষ্প্রাণ। প্রায় জনশূন্য। অনেকে এলাকা ছেড়ে রোজগারে শহরের পথে। যারা এলাকায় থাকেন, তারাও কর্মহীন বসে থাকে। হাটবাজারের হোটেল, দোকানপাট সবই যেন ঝিমিয়ে থাকে। ওই সময়ে দোকানপাটে বকেয়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। দোকানিরা ক্রেতাকে বাকি দেন এই মৌসুমের দিকে চেয়ে।

ভোলা সদরের তুলাতলী ঘাট। সাক্ষাত সফিকুল ইসলামের সঙ্গে। খুব ব্যস্ত। মাছ উঠছে। কথা বলার সময় নেই। সময় নিয়ে একটু আলাপ। কেমন আছেন? জবাব একশব্দে- ভালো। মাছ কেমন পড়ছে? জবাব- বেশ। ইলিশ মৌসুম এমন একটা সময় যখন জালে ইলিশ উঠলে জেলে আনন্দিত হয়। আর ইলিশ না পড়লেই তাদের মন খারাপ। আগস্ট ২০১৯ পর্যন্ত এক হিসাবে জানা যায়, এই সময়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। গত বছর এই সময়ে আরও অনেক বেশি ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল। জেলেরা জানালেন, এবার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে ইলিশের পরিমাণ অনেক কম। তবে সমুদ্রে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বেশ। তবে সব জেলের পক্ষে সমুদ্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। সমুদ্রগামী মাছধরা ট্রলারের সাইজ বড়, তাতে লোক লাগে ১৫ থেকে ১৮জন। সে ক্ষেত্রে পূঁজিও লাগে বেশি। সে কারণে সকল মাঝি-জেলের পক্ষে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া সম্ভব হয় না। লক্ষ্মীপুরের মতিরহাটের মাঝি আলাউদ্দিন বলেন, ইলিশ ধরা অনেকটা লটারির মতো। পূঁজি খাটিয়ে আমরা নামি ইলিশ ধরতে। পাবো কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে এবার মোটামুটি ইলিশ পড়ছে। নদীতে এবার ইলিশ কম। সমুদ্রের দিকে ইলিশ বেশি পড়ছে। আমরা সারাবছর এই মৌসুমটার জন্যই অপেক্ষা করি। বাড়তি কিছু আয় রোজগার করতে পারবো কিনা জানি না, তবে মৌসুমটা মোটামুটি ভালো থাকা যায়; ধারদেনা কিছুটা শোধ করতে পারি। ঢালচরের নুরুদ্দিন মাঝি বলেন, এবার মোটামুটি ইলিশ পাচ্ছি। হয়তো ধারদেনা শোধ করতে পারবো। গত বছর ইলিশ মৌসুমে তো কেবল মাছ পাওয়া শুরু করেছিলাম; এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেল প্রজনন মৌসুমের নিষেধাজ্ঞা।

 

 

বছরে প্রধানত তিনবার ইলিশ জেলেরা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন। মার্চ-এপ্রিল জাটকা মৌসুম। ইলিশকে বড় হতে দিতে হবে। কড়া আইন, নদীতে জাল ফেলা যাবে না। আর তাই এ সময়ে জেলেরা বেকার জীবন কাটায়। অনেকে শহরে ছুটে কাজের সন্ধানে। নিষেধাজ্ঞার এই দুই মাস পার হলে জেলেরা মোটামুটি উৎসবের আমেজে নদী-সমুদ্রে জাল ফেলেন। ইলিশ মেলে; অথবা মেলে না। তবে মে-জুলাইয়ে সাধারণত ইলিশ ততটা পড়ে না। মূল সময়টা অক্টোবর-সেপ্টেম্বর। পহেলা মে ইলিশ ধরার উৎসবে নেমে মাত্র কুড়ি দিনের মাথায়, অর্থাৎ ২০ মে ইলিশ ধরায় আবার নিষেধাজ্ঞা। চলে টানা ৬৫দিন। পঁয়ষট্টি দিনের এই আইনটা আগেও ছিল। কিন্তু এতটা কড়াকড়ি ছিল না। এবার সরকার এ আইনটি বাস্তবায়নে কঠোর হয়। তবে এই সময়টা সমুদ্রে মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে; নদীতে নয়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মোটামুটি ইলিশ পাওয়া-না পাওয়ার মধ্যে কেটে যায়। এরমধ্যেই আবার অক্টোবরের প্রথম অথবা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রজনন মৌসুমের ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়।

সময় এখন ইলিশের। মাছের রাজার দখলে মাছ বাজার। সমুদ্র-নদী থাকে মাছের রাজা ইলিশের। সমুদ্র-নদী থেকে ইলিশ ওঠে। পুবাল হাওয়া আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশ পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে। পুবাল হাওয়ায় জোয়ারের পানিও বাড়ে, মাছধরা জেলেদের অনেকের ঘরদোর ভেসেও যায়। তবুও ইলিশ পেলে আনন্দে ভরে মন। আবার ভাটা পড়ে কখনো- ইলিশ একেবারেই মেলে না। তবুও ইলশে সময়- সমুদ্র-নদী তীর থেকে রাজধানী পর্যন্ত সব মানুষের কাছে নিয়ে আসে অন্যরকম সময়। নাগালেই ইলিশ। হাত বাড়ালেই ইলিশ। যেটা অন্য সময় ভাবাই যায় না।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়