‘মানুষটা চ্যাপ্টা হলে দায়ভার কে নেবে?’
হোসাইন মোহাম্মদ সাগর: রাজধানীর ইস্কাটনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ফয়জুর রহমান। বাসা হাতিরপুল। বাংলা মোটর মোড়ে এসে একবার তাকালেন হাত ঘড়ির দিকে। তারপর মহাসড়কের দ্রুত বেগের গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হলেন বেশ ঝুঁকি নিয়ে। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও এভাবে কেন রাস্তা পার হলেন?’ খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন তিনি- ‘হাতে সময় কম আর ওভারব্রিজে ওঠা-নামা কষ্ট, তাই।’
ফয়জুর রহমান দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে চলে গেলেন। কিন্তু শুধু ফয়জুর রহমান নন, এক গবেষণা বলছে- ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হন। যার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জনগণের কাছে ফুটওভার ব্রিজে ওঠা-নামা কষ্টকর ব্যপার এবং তারা খুব কম সময়ে রাস্তা পার হতে ইচ্ছুক।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও জনগণ চলন্ত গাড়িগুলোর মাঝ দিয়ে এলোমেলোভাবে রাস্তা পার হচ্ছে। কয়েক মিনিট সময় বাঁচানো বা একটু কষ্ট না করার জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাজধানীর শাহবাগ, বাংলা মোটর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, বনানী এবং মিরপুর এলাকায়। বিশেষ করে মিরপুর গোল চত্বরের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে ওভার ব্রিজের নিচেই পথচারী অব্দুল হামিদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। হামিদ সলজ্জ কণ্ঠে বলেন, ‘ওভার ব্রিজটা ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না। জানি এটা উচিত না। আসলে গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হওয়া যায় বলেই ওভার ব্রিজে আর ওঠা হয় না।’
পথচারী খলিলুর রহমানের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। এদের সাইকোলজি বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কী এক অদ্ভুত কারণে আমরা ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাস্তার মাঝখান দিয়ে বড় বড় গাড়ির ফাঁক-ফোকর গলে রাস্তা পার হতে পছন্দ করি ঠিক বুঝি না! এমনকি অনেক বাবা-মাকেও দেখি, তাদের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে নির্বিকারভাবে রাস্তা পার হচ্ছেন!’
ফুটওভার ব্রিজের পরিবর্তে নির্বিকারভাবে রাস্তা পারাপারে যেমন রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, তেমনি এর ফলে সৃষ্টি হয় যানজট। এমনকি এই মানুষগুলোর ফলে রাস্তার গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সমস্যা পোহাতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। এমনটাই জানালেন বাংলা মোটর মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এদের কথা আর বলবেন না ভাই। ওভার ব্রিজ পড়ে আছে ফাঁকা, তবুও এরা ব্যস্ত সড়কের মাঝ দিয়ে রাস্তা পার হবে। মানুষগুলোর এমন এলোমেলো চলাচলের জন্য আমরাও ঠিকভাবে কাজ করতে পারি না। গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণে ঝামেলা হয়। এরা হরহামেশা এসে ব্যস্ত সড়কে ঢুকে পড়ে। সামান্য সিগন্যালের জন্যও অপেক্ষা করে না।’
কথাগুলো বলতে বলতেই আঙুল তুলে দেখালেন তিনি- ঐ যে দেখেন, দুটো গাড়ির মাঝ দিয়ে মানুষটা কীভাবে রিস্ক নিয়ে যাচ্ছে! এখন দুটো গাড়ির ধাক্কায় মানুষটা চ্যাপ্টা হলে দায়ভার কে নেবে?’
একই কথা বললেন বলাকা পরিবহনের চালক হাফিজুল ইসলাম। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘রাস্তার মাঝ দিয়ে পার হলে আমাদেরও গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয়। ওভার ব্রিজ ব্যবহার করবে না, আবার সড়ক পার হওয়ার সময় বাসের একটু ধাক্কা লাগলেই শুরু হয়ে যায় অবরোধ। তখন যতো দোষ ড্রাইভারদের। তারা আইন মানবে না, অথচ খেসারত দিতে হবে আমাদের।’
যত্রতত্র রাস্তা পারাপারে জেল জরিমানার আইন থাকলেও তা কেন প্রয়োগ হচ্ছে না জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো লাভ নেই! বহুবার বাংলা মোটর মোড়ে মোবাইল কোর্ট বসানো হয়েছে। অনেককে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন পরে আবার যা তাই! আমরা আসলে নিজের ভালোটা বুঝতে চাই না।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জুবাইদা খানম বলেন, আমরা চলন্ত গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হতে ৫-৭ মিনিট রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু ২-৩ মিনিটের জন্য ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারি না। এ জন্য আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজন; সাথে একটু সুব্যবস্থা। লক্ষ্য করুন কোথায় কোথায় আইনটা বেশি অমান্য হচ্ছে? ক্যান্টনমেন্টে কিন্তু এমন দেখা যায় না। সেখানে ঠিকই সবাই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছে। ফার্মগেটের মূল ওভার ব্রিজটা দেখুন, ওটাও সবাই ব্যবহার করছে। কেন? কারণ সেখানে দ্বিতীয় অপশন নেই। ওই জায়গাগুলোতে রাস্তার মাঝে কাটাতারের রেলিং দেওয়া। রাস্তা দিয়ে পারাপারের কোনো ব্যবস্থা সেখানে নেই। যেখানে আছে মানুষ তো সে সুযোগটা নেবেই। তবে এটা ঠিক নয়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ আগস্ট ২০১৭/সাগর/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন