ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মালয়েশিয়ায় রসগোল্লার খোঁজে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মালয়েশিয়ায় রসগোল্লার খোঁজে

(ভিয়েতনামের পথে: ৩৮তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: ভ্রমণ পরিকল্পনার শুরুর দিক থেকেই মনের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছিল- মালয়েশিয়াতে ঢুকতে পরব তো? পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখালেখিও হয়েছে বেশ। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের সাথে সে দেশের বিমান বন্দরে অপ্রিতীকর আচরণ করা হচ্ছে। সারিতে দ্বন্ডায়মান যাত্রীদের মাঝ থেকে বাংলাদেশিদের আলাদা করে শুধু যে অযথা কালক্ষেপণ করেছে তাই নয়, অনেককেই দেশে পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছে। এমন সংবাদও পাওয়া গেছে, ফিরিয়ে দেয়ার আগে অনেক যাত্রীকে আলাদা ঘরে বন্দি করে অপমান-নির্যাতন এমনকি অর্থকড়ি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সমস্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মনের ভেতর ভীতি তাড়া করে বেড়িয়েছে। ওরা তাদের দেশে ঢুকতে না দিলে ক্ষতি নেই, অন্য কোনো ফিরতি বিমানে দেশে পাঠিয়ে দেবে। মাঝখান থেকে ভেস্তে যাবে আমাদের পরোবর্তী গন্তব্য ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের স্বপ্ন। আর সেই ক্ষতির পরিমাণ নিঃসন্দেহে অপূরণীয়।

ঘোষণা এলো কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান কুয়ালালামপুর অবতরণ করবে। উপর থেকেই দেখা দিল বিস্তীর্ণ সবুজ বীথি। নিকট উচ্চতা থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সুবিন্যস্ত সবুজ বৃক্ষের সারি অন্য কিছু নয় পাম গাছ। খেজুর গাছের মতো দেখতে। পাম বাগানের উপর দিয়ে চক্কর দিতে দিতে স্পর্শ করল মালয়েশিয়ার মাটি। ঘড়ির কাঁটায় এখানে স্থানীয় সময় বিকেল তিনটা। আনুষ্ঠানিকতার জন্য বিমন বন্দরের এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে ছোট্ট একটি ভ্রমণ করতে হয়। মাত্র দুই কি আড়াই মিনিটের রেলপথ। পথের কিছুটা মাটির উপর দিয়ে আর বাকিটুকু নিচ দিয়ে।
 


দাঁড়িয়ে আছি দীর্ঘ সারিতে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অনেক লোক জমে গেল। বাম পাশের খালি কউন্টারগুলিতে এসে একজন করে বসলেন এবং কিছু লোক তুলে নিয়ে তাদের সামনে নতুন সারি তৈরি করা হলো। মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছি আর মনের ভেতর ক্রমবর্ধমান শঙ্কা প্রশমনের চেষ্টা করছি। লক্ষ করছি, যাত্রীদের গায়ের রং ভেদে কাউন্টারে বসা কর্মকর্তাদের ব্যবহারে তারতম্য স্পষ্ট প্রতিয়মান। পৃথিবীতে যারা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে তারাই এই হীন সংস্কৃতি থেকে বেরিযে আসতে পারেনি, আর এ তো মালয়েশিয়া! শরীরের রং যেহেতু বদলানো সম্ভব নয় তাই চালচলনে অবিরত কৃত্রিম কিছু উপাদান যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। বুঝাতে চাই, আমি পর্যটক, অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। পরোক্ষণে এ-ও বুঝতে পারছি গত কয়েক দিন চষে বেড়ানোর ফলে যে চেহারা হয়েছে তাতে এই সব নকল প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার যত চেষ্টাই করি না কেন কাজ হবার নয়! এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এসব করতে গিয়ে নিজের কাছে নিজেকে এতটাই ছোট আর সস্তা মনে হলো যে তা বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। অপমানের গ্লানি আপাদমস্তক গিলে ফেললো। আজকের এই বাস্তবতার পেছনে যতটুকু দায়; তার প্রায় সবটুকুই আমাদের। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমি আসামীও না, ভিখারীও না। আবার কোনো মাণ্যবরও হতে আসিনি। এক নজর ঘুরে দেখতে এসেছি তাদের দেশ। সুতরাং, স্বাভাবিক ব্যবহারের প্রত্যাশা আর সারিতে দাঁড়িয়ে শঙ্কায় না ভোগা কি আমার অধিকার হবার কথা নয়? এত সব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই নিজের মাঝ থেকে খুলে পরেছে প্রচেষ্টার সব কসরত। কুয়ালালামপুর বিমান বন্দর অনেক বড়। বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাওয়া সহজ কথা নয়। মুদ্রা পরিবর্তন করে নিচে এসে দেখি বাস প্রায় ছেড়ে দিচ্ছে। অমনি টিকিট কেটে উঠে পরলাম।

এখানে আমাদের ঠিকানা ১৪ পিজেএস, ১০/২৬, সানওয়ে পিরামিড- অনুজতুল্য বন্ধু মোস্তাক মোহাম্মদ শাওনের নিবাস। তার সাথে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে ব্যাংকক ছাড়ার আগে। ওর দেয়া ঠিকানা মোতাবেক এই পর্যায়ের গন্তব্য সেন্ট্রাল মার্কেট। সেন্ট্রাল মার্কেট পর্যন্ত দেড় ঘণ্টার পথ। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছুটল দুরন্ত গতিতে। কোনো যানজট নেই। বনজঙ্গল, পাম বাগান এবং হালকা পাতলা বসতি, এসবের মাঝ দিয়েই সড়ক। এক পর্যায়ে গাছপালার উপর দিয়ে বহুদূর থেকে দৃশ্যমান হলো কুয়ালালামপুরের আকাশচুম্বি ভবনগুলি। এক থোকা দালানের মাঝ থেকে আলাদা করে চেনা যায় বিশ্বের উচ্চতম ভবন পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। আকাশে মেঘ আর রদ্দুর উভয়েরই প্রতাপ। দুয়ের যোগফলের প্রভাবে টাওয়ার হারিয়েছে তার আসল রং। ধূসর বা কালচে রং এর দালানটিকে সাদা দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ঢুকে পরলাম থোকা থোকা সুউচ্চ দালানের নগরে। সেন্ট্রাল মার্কেট বাস টার্মিনাল কোনো উড়াল সেতু অথবা উড়াল রেলপথের নিচে অবস্থিত। অন্ধকার প্রায় সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলাম সূর্যের আলোয়। এখানেই কর্তব্যরত একজন জানালেন সানওয়ের বাস মিলবে পাসার সেনি নামক জায়গা থেকে। বাস টার্মিনাল থেকে পাসার সেনি বেশি দূরে নয়, পায়ে হাঁটা পথ। এখন পর্যন্ত যা দেখছি তাতে স্থানীয়দের চেয়ে ইন্ডিয়ান এবং বাংলাদেশির সংখ্যাই যেন বেশি। পাসার সেনি মোড় একাধিক রাস্তার মিলন স্থল। ঠিক কোন পথে যেতে হবে প্রথমে তার হদিস করে নেয়া দরকার। ব্যস্ত জায়গা, মানুষগুলির মাঝে এক ধরনের তাড়াহুড়ো; কার কাছ থেকে জেনে নেব সেটা ঠিক করতেই পেরিয়ে গেল দশ মিনিট।
 


চারপাশে বহু দেশের মানুষের বিচরণ। ভারতীয় উপমহাদেশ ব্যাতীত অন্য সকলের চেহারা প্রায় কাছাকাছি। সুতরাং কে মালয়, কে চাইনিজ আর কে ইন্দোনেশিয়ান তা নির্ণয় করা জটিল। তবে ভাষাগত জটিলতা নেই, টুকটাক ইংরেজি সকলেরই জানা। জিজ্ঞেস করলে প্রথম লোকটির কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেয়ে গেলাম। কত নাম্বার বাসে উঠতে হবে দেখিয়েও দিলেন। নগর সেবায় নিয়োজিত এখানকার বাসের মান অনেক উন্নত, ইয়োরোপের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পাশে বসা যাত্রীর নিকট জানতে চাইলাম আমাদের গন্তব্যের দূরত্ব কত দূর? উত্তর দিলেন কিছু একটা, তবে তার মধ্যে কোনো প্রাণ নেই। দ্বিতীয় কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে এবার এড়িয়ে চলার স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রকাশ পেল। তার সমগোত্রীয় অন্যদের মাঝ থেকে কয়েক জন আমাদের দিকে ঠিক একই অভিব্যক্তিসুলভ তাকিয়ে আছে। বুঝতে এতটুকুও বেগ পেতে হলো না এখানে আমাদের অবস্থান কোথায়। পরিস্থিতি অবলোকনপূর্বক অল্প ব্যবধানে দাঁড়ানো একজন বাঙালি জানালেন, তিনিও একই জায়গায় নামবেন। সানওয়ে পিরামিড নেমে দু’এক জনের কাছে বাসার ঠিকানা জানতে চাইলে বাঙালি যুবকটি আবারও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন এবং নিজ ফোন থেকে রিং দিয়ে শাওনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। দক্ষিণ কোরিয়া ফেরৎ মুন্সিগঞ্জের যুবক দ্বিতীয় প্রবাস হিসেবে বেছে নিয়েছেন মালয়েশিয়াকে। এখানে কয়েক দিন অবস্থানের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, আমাদের দেশের মানুষ সম্পর্কে স্থানীয়রা কি ধারণা পোষণ করে।

কয়েক বছর পর মোস্তাক মোহাম্মদ শাওনের সাথে দেখা। এই বাড়িতে পাঁচ/ছয় জন মিলে থাকে। দুই তলা ছোট্ট বাড়ির নিচ তলায় শাওনের ঘরেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ভেতরে ঢোকার আগেই এক সুপরিচিত সুগন্ধে নাসিকাজোড়া অকস্মাৎ সজাগ হয়ে উঠল। তর সইছে না, মনে হচ্ছে জন্ম জন্মান্তর পেরিয়ে গেছে এমন সুবাস পাই না! রান্না ঘরে গিয়ে দেখি অ্যালুমনিয়ামের চওড়া কড়াইয়ের মধ্যে পেঁয়াজ কশানিতে ডুবে আছে টুকরো টুকরো মুরগির মাংস। ঝটপট একটা গোসল দিয়ে খেতে বসা। শাওনের রান্নার হাত এত পাকা তা জানা ছিল না। মশুর ডালের ভাজিটাও যেন অমৃত! ভোজন তো পূর্ণ হলো না, এমন খাওয়া-দাওয়ার পর একটা রসগোল্লা না হলে তাকে মানানসই বলি কি করে! কিন্তু এখানে কি রসগোল্লা পাওয়া সম্ভব? শাওন বলল, চিন্তার কারণ নেই, তারও বন্দবস্ত হবে। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়