ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মাহবুবের নাম শুনলে আজও ভয় পান মির্জাপুরের বয়স্করা

শাহরিয়ার সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২২, ২৮ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাহবুবের নাম শুনলে আজও ভয় পান মির্জাপুরের বয়স্করা

নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল : প্রখ্যাত দানবীর ও শিক্ষানুরাগী রণদা প্রসাদ সাহা হত্যাকান্ডে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত রাজাকার মাহবুবুর রহমান ছিলেন ১৯৭১ সালের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের এক আতঙ্কের নাম। মুক্তিযুদ্ধের বছর অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং নির্যাতন করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, তেমনি যুদ্ধের পর জেল থেকে বের হয়েও দাপট দেখিয়েছেন প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়।

টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের বাইমহাটি এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমানের বাবা মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মির্জাপুর এলাকার শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। সেই প্রভাব খাটিয়ে বখাটে কিশোর এলাকায় হত্যা-লুতটরাজ চালাতেন মাহবুবুর রহমান ওরফে মইপা ও তার ভাই আব্দুল মান্নান। বিশেষ করে মির্জাপুরের হিন্দু অধ্যুসিত এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চলতো। তাদের কথার অবাধ্য হলেই ধরে নিয়ে যাওয়া হতো পাক বাহিনীর কাছে। তারই  অংশ হিসেবে মাহবুবুর রহমান ওরফে মইপার নেতৃত্বে হত্যা করা হয় রণদা প্রসাদ ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদসহ ৭ জনকে যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। 

শুক্রবার সকালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পৌরসভার বাইমহাটি এলাকায় মাহবুবুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় দরজায় তালা ঝুলছে। তবে খোলা রয়েছে ঘরের জানালা। সেই জানালা দিয়ে ঘরের তেমন কোন অংশ চোখে পরে না। মাহবুবুর রহমানের বাসার ভাড়াটিয়ার কাছে তার পরিবারের খোঁজ জানতে চাইলে তারা কোন তথ্য দিতে পারেননি। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, গত দুদিন ধরে ঘরে তালা দিয়ে মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী ও তার দুই ছেলে কোথায় গেছে সেটা তারা বলতে পারেন না।

মাহবুবুরের বাড়ি থেকে বের হয়ে স্থানীয়দের কাছে তার সম্পর্কে জানতে চাইলে অনেকেই বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌর মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহবুবুর রহমানের বাবা মাওলানা আব্দুর ওয়াদুদ ছিলেন এই এলাকার শান্তি বাহিনীর সভাপতি। সেই সময় তার দুই কিশোর ছেলে মাহবুবুর রহমান আর তার ছোটভাই আব্দুল মান্নান পুরো উপজেলায় বাবার ক্ষমতা দেখাতেন, সাধারণ মানুষকে হয়রানি করতেন। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মবলম্বীদের প্রতি খুব নির্দয় ছিলেন এই মাহবুব। তার ডাক নাম ছিলো মইপা। যুদ্ধের সময় তার বাবা মাওলানা ওয়াদুদ নিহত হন। যুদ্ধের পর মাহবুব কয়েক বছর জেল খাটেন। জিয়া সরকারের আমলে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ফিরে আসেন।

রাজনৈতিক কোন পদে না থাকলেও, মাহবুব জামায়াত ইসলামের রাজনীতির অনুসারী ছিলেন। তার কোন পেশা না থাকলেও তিনবার মির্জাপুর সদর ইউনিয়ন নির্বাচন ও একবার পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন। যদিও এসময় কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন তিনি পাননি। প্রতিটি নির্বাচনেই সামান্য কয়েকটি ভোট পাওয়ায় পরাজিত হন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বিভিন্ন প্রভাবশালী আত্মীয় আর উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক থাকায় এলাকায় নানা প্রভাব ফেলার চেষ্টা করতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার অবস্থান নিয়ে কেউ কোন কথা বললে তাকে নানাভাবে হুমকি দিতেন। স্থানীয় কোন সংবাদকর্মী মুক্তিযুদ্ধ সময়কালের বিষয়ে কোন কিছু লিখলেও তাকে গালামন্দ করতেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করার পর থেকেই প্রায় একঘরে হয়ে যান মাহবুব। স্থানীয়দের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের অপরাধের বিষয়ে বিচারের দাবি আসার পর অনেকটাই রোষানলে পরেন তিনি। সে সময় এলাকার কারোর সাথে তেমন মেলামেশাও ছিলো না মাহবুবুর রহমান ও তার পরিবারের। তিনি নিজে কোন পেশায় সংশ্লিষ্ট না থাকলেও, তার স্ত্রী প্রশিকা নামের একটি এনজিওতে চাকুরী করেন। দুই ছেলেকে নিয়ে তাদের পরিবার অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন থাকতেন।

প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে মাহবুবুর রহমানের ভাই আব্দুর মান্নান যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর গেলো বছর যুদ্ধাপরাধীর মামলায় মাহবুবুর রহমান গ্রেফতারের পর তার স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে একতলা এই টিনসেট বাড়িতেই থাকতেন। বাড়ির একপাশে বাসা ভাড়া দিয়ে চলতো তাদের সংসার। বৃহস্পতিবার রণদা প্রসাদ সাহা হত্যাকান্ডে মাহবুবুর রহমানের ফাঁসির আদেশের পর শুক্রবার সকালে তার অপর এক ভাইকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কোথাও চলে যেতেও দেখেছেন স্থানীয় কয়েকজন।

বিশ্বজিত দত্ত নামের মাহবুবুর রহমানের প্রতিবেশী এক বয়োবৃদ্ধ মুদি দোকানী বলেন, যুদ্ধের সময়ে মাহবুব ও তার ভাই তাদের বাবার ক্ষমতায় এই এলাকায় অনেক অত্যাচার করেছে। বিশেষ করে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর তাদের অত্যাচার ছিলো বেশি। মাহবুব ও তার ভাইয়ের ভয়ে আমরা হিন্দুরা সব সময় আতঙ্কে থাকতাম। তারা দুই ভাই তাদের সহযোগীদের নিয়ে মির্জাপুর, বাইমহাটি, সরিষাদাইড়, কান্ঠালিয়া ও আন্ধরা গ্রামে ৩৩ জনকে গণহত্যা করেছিলো। এছাড়া পুষ্টকামুরী, দূর্গাপুর, সরিষাদাইড়, কান্ঠালিয়া, আন্ধরা, বাইমহাটি ও মির্জাপুর গ্রাম থেকে ২২ জনকে অপহরণ করে মধুপুর বনে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করেছে বলে শুনেছি। তাদের নেতৃত্বেই পাক বাহিনী মির্জাপুর সদরের পুষ্টকামুরী গ্রামের বাসিন্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের বাবা জয়নাল সরকারকে ঘরের ভেতর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, ওই একই দিনে নিজ বাড়িতে আওয়ামী লীগের অফিস করায় ও লুটতরাজে বাধা দেওয়ায় ওই গ্রামের আযম আলী শিকদার নামে একজনকে পাকবাহিনী দিয়ে নির্যাতন করায় মাহবুব। সে সময় আযম আলী শিকদারকে  পাকিস্তান- জিন্দাবাদ বলতে বলার পর তিনি সেটা না বলে ‘জয় বাংলা’ বলায় তাকে মির্জাপুর বাস স্ট্যান্ডের কুমুদিনী হাসপাতালের প্রাচীরের সাথে দাঁড়া করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

 

 

মির্জাপুর পৌরসভার সাহাপাড়ার নিবাসী নিতাই পাল বলেন, আমি নিজেও শহীদ পরিবারের সন্তান। এই এলাকার মাহবুব রাজাকার ও তার বাবা-ভাই মিলে আমাদের হিন্দুদের উপর অনেক অত্যাচার করেছে। ধন-সম্পদ লুট করেছে। শুধু তিনি একাই নন, তার সাথে মির্জাপুরের আরও অনেকেই সহযোগীতা করেছে। রণদা প্রসাদ হত্যার ঘটনায় মাহবুবুর রহমানের ফাঁসির রায় হলেও তার অনেক সহযোগী এখনও জীবিত আছে। তাদেরও এমন বিচারের আওতায় আনা জরুরী।

মাহবুবুর রহমান সম্পর্কে জানতে চাইলে, স্থানীয় সংবাদকর্মী ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক দূর্লভ বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে মাহবুব তার ডান পায়ের সাথে পিস্তল রাখতো। কেউ তার কথার অবাধ্য হলেই তাকে গুলি করে হত্যার ভয় দেখাতো। নারী-পুরুষ কেউ তার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতো না। এই এলাকায় সে অনেক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে সর্বপ্রথম মির্জাপুর উপজেলাতে তাদের পরিবারের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু হয়েছিলো। অনেক নিরীহ মানুষদের সে হত্যা করেছে। রণদা প্রসাদের মতো দানবীর ব্যক্তিও তার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। স্বাধীনতার পরে কিছুদিন জেল খাটলেও, ছাড়া পাবার পর থেকে সে বহাল তবিয়তে ছিলো।

কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার পরিচালক (শিক্ষা) ও ভারতেশ^রী হোমসের সাবেক অধ্যক্ষ ও একুশে পদক প্রাপ্ত প্রতিভা মুৎশুদ্দি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মে, রণদা প্রসাদ সাহা ও ভবানী প্রসাদ সাহা সহ ৭ জনকে রণদা প্রসাদ সাহার নারায়নগঞ্জের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেই ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাহবুবুর রহমান ও তার ভাই আব্দুল মান্নান। তাদের সাথে ছিলেন ২০-২৫ জন হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার। সেখান থেকে ধরে নিয়ে রণাদা প্রসাদ সহ সবাইকে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। পরে আর তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। তার আগে সেদিন সকালে মাহবুব তার সহযোগীদের নিয়ে মির্জাপুর বাজারে লুটপাট চালিয়েছিলো। সাহা পাড়ায় নিরাপরাধ গ্রামবাসীদের পাক বাহিনী দিয়ে হত্যা করে বংশাই নদীতে ফেলে দিয়েছিলো। অনেক নারীকে তারা অত্যাচার করেছে। শুধু রণাদা প্রসাদকে হত্যা করাই নয়, তার উদ্দেশ্য ছিলো রণদার সব জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসহ হিন্দু সম্প্রদায়কে ধংস করা। আর এতো বছর পর মাহবুবুর রহমান তার অপরাধের সাজা পেতে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গতকাল বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে হত্যাসহ গণহত্যার তিন ঘটনায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের যুদ্ধাপরাধী মাহবুবুর রহমানের ফাঁসির রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।


রাইজিংবিডি/ টাঙ্গাইল/ ২৮ জুন, ২০১৯/ সিফাত/ সাজেদ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়