ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মি. ক্যাপ্টেন, জন্মদিনে লও প্রণতি

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২১, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ১৬:৪৫, ৫ অক্টোবর ২০২০
মি. ক্যাপ্টেন, জন্মদিনে লও প্রণতি

আমাদের একজন ক্যাপ্টেন ছিল, দেশটা তার দেখা হয়নি কিন্তু দেশটা সে আমাদের দিয়ে গেছেন। নাম তাঁর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। চাঁপাই নবাবগঞ্জে মাটির গহীনে সে শুয়ে আছে; স্বাধীন মাটি, শত্রুমুক্ত মাটি। এ মাটিকে শত্রুমুক্ত করতে করতে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে জীবনটাই বাজি ধরেছিলেন এই বীরশ্রেষ্ঠ; শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন গোটা দলকে কিন্তু নিজে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। বীরেরা এমনই হয়-বীর মানেই ত্যাগ, বীর মানেই বীরত্ব আর ত্যাগের অসাধারণ মিশেল।

ক’দিন আগে আমাদের আরেক ক্যাপ্টেনকে দেখি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে। যান্ত্রিক ত্রুটিতে বিমানের চাকা খুলবে না, আকাশে থাকতেই সবার তা জানা হয়ে যায়! ১৬৪ যাত্রী, ৭ ক্রু- সবার দশা এক; কী হবে, কী হবে? ডানা ভাঙা পাখির মতো আকাশের গায়ে গোত্তা খেতে থাকে ইউএস বাংলা কোম্পানির বিমানটি। কিন্তু ক্যাপ্টেন জাকারিয়া বাজি ধরলেন, বিমান নামাবেন চাকা ছাড়াই! অপরিসীম সাহস আর দক্ষতার মিশেলে ঠিকই তিনি বিমান ল্যান্ডিং করেন সামনের চাকা ছাড়াই! অবিশ্বাস্য, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়; একজন ক্যাপ্টেন বাঁচিয়ে দেন ১৭১টি জীবন। আমাদের ক্যাপ্টেনরা সব জীবনদায়ী।

এমন অনেক ক্যাপ্টেন আমাদের আছে। আমাদের দুঃখের দিনে তারা হয়ে ওঠেন ত্রাতা, আমাদের নিরাশায় তারা হন আশা। মাশরাফি বিন মুর্তজা নামে একজন ক্যাপ্টেনও আমাদের আছে, যিনি ক্রিকেট মাঠে লড়াই করেন আমাদের জন্য। লড়াই করতে করতে তাঁর হাঁটুতে পানি জমে যায়, ব্যথা হয় কিন্তু ক্যাচ উঠলে তিনি লাফিয়ে ওঠেন আকাশে, পাখির মতো ছোঁ মেরে তিনি তা লুফে নেন। পড়ে গিয়ে আরো বেশি ব্যথা পান কিন্তু আমাদের তা বুঝতে দেন না, সোজা দাঁড়িয়ে যান বল হাতে। বীরত্ব দেখাতে হয়, ব্যথা থাকলেও, কষ্ট হলেও; এটা বোঝেন মাশরাফি। না দেখালে আগামীতে বীর কীভাবে জন্মাবে, লড়াকু সৈনিক কীভাবে তৈরি হবে! মাশরাফি বীর হন, বীর বলেন, নিজের জন্যে নয়, আমাদের জন্য, জাতির জন্য, দেশের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।

দুনিয়ার দেশে দেশে ক্যাপ্টেনেরা মরিয়া হয়ে থাকেন শিরোপা জেতার জন্য। শিরোপা না জিতলে নাকি সবই বৃথা। কেউ তাদের স্বীকৃতি দেয় না, পুরস্কার দেয় না, প্রশংসা করে না। কিন্তু ক্যাপ্টেন মাশরাফি? নাহ্, তিনি শিরোপার জন্য লালায়িত না; তিনি এমন এক ক্যাপ্টেন যার মুখ থেকে এই জনমে প্রথম শুনলাম এক অভূতপূর্ব, স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণ-‘শিরোপার জন্য আমি খেলি না, শিরোপা দিয়ে যদি আমাকে বিচার করেন, সে বিচার আমি মানি না; আমি দেশের জন্য খেলি, নিজের সবটুকু দিয়েই খেলি, জিতলেও আমি যা, হারলেও আমি তা-ই। একটা শিরোপা বাংলাদেশের জেতা দরকার, আমার নয়; শিরোপা না জিতলে কি কেউ আমাকে মনে রাখবে না? মনে না রাখলে না রাখবে- আমি এতকিছু চিন্তা করে খেলি না, আমি এত সস্তা নই যে, এভাবে চিন্তা করব, কেবল শিরোপার জন্য খেলব।’

মরুর বুকে এশিয়া কাপ। অসহনীয় গরম, অচেনা কন্ডিশন, সুবিধাবাদি মোড়ল, পক্ষপাতি মাতব্বর আইসিসি-শত্রুর অভাব নেই। তবু ফাইনালের মঞ্চে দেশের নাম বাংলাদেশ, ক্যাপ্টেনের নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা। ফাইনাল শেষে ক্রিকেটের পণ্ডিত রমিজ রাজা বললেন, ‘মাশরাফি হলেন কাপ্তান অব এশিয়া।’ বললেন, ‘বাংলাদেশ শুধু শিরোপা পায়নি, পেয়েছে বাকি সব! সাহস, মনোবল আর চোখে চোখ রেখে লড়াই করার মানসিকতা- টাইগাররা পেয়েছে এর সবকিছুই। মাশরাফির তো দরকার এগুলোই। এগুলো থাকলেই তো বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে; এগুলো থাকলেই তো আগামীতে শিরোপার উৎসব হবে। মাশরাফি তো বর্তমানে পড়ে নেই, তাকে চিন্তা করতে হয় ভবিষ্যৎ নিয়েও। বাংলাদেশের একটা ভবিষ্যৎ আছে, মাশরাফির চোখে সেখানে আলো আছে।

যুদ্ধের ময়দানে সশস্ত্র ক্যাপ্টেন তার সৈন্যবাহিনীকে কী বলেন? জান দিয়ে লড়তে হবে! মাশরাফিও তাই বলেন, ‘যুদ্ধে নামলে পিছু হটবার সুযোগ নাই; হয় মারবি, নয় মরবি!’ পাকিস্তান ম্যাচের আগে ডু অর ডাই সিচুয়েশনে হাতের সবচেয়ে কুশলী তরুণ মুশফিককে বলেছিলেন এটি। কেমন আশ্চর্য লাগে না? একটা লোক এত কী করে পারে! মানুষ তো, নাকি? সত্যিই, মাঝে মাঝেই ভাবনার জগতে আলোড়ন ওঠে-সেকি মানব নাকি অতি মানব, নাকি মহামানব! মাশরাফি আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতাকেও এভাবে চ্যালেঞ্জ জানায়।

ফাইনালে যখন মামুলি টার্গেট প্রতিপক্ষের, আমরা বাংলাদেশের সব মানুষ আশা ছেড়ে দিই। রিমোটের বোতাম টিপে বন্ধ করে দিই টিভি। ধুর! আর টিভি-ই দেখব না! কিন্তু মাশরাফি কখনো আশা ছাড়েন না। তিনি অল্প পুঁজিকেও প্রতিপক্ষের কাছে পাহাড় সমান করে তুলেন। কেউ ব্রেক-থ্রু দিতে পারছে না? মাশরাফি নিজেই এগিয়ে আসেন, তিনি নিজেই শিকার করেন বড় বড় মাছ। তারপর ঘটনা হয় এমন-আমরা ১৬ কোটি মানুষ আবার গোল হয়ে বসি, মাশরাফির প্রেরণায় আমরা প্রাণিত হই, ছুঁড়ে ফেলা টিভি রিমোটকে আবার কাছে টানি; জয়ের আশায় আমাদের হৃদয়ে নাচন ওঠে; চোখের ঘুম হারিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে! কিছু সময় পরপর আমরা হৈ হুল্লোড় করি; আমরা জপ করি, মোনাজাত করি, আল্লাহ আল্লাহ করি! উচ্ছ্বাস, উৎকণ্ঠা, রোমাঞ্চ-কয়েক ঘণ্টায় সবকিছুর মধ্য দিয়ে যাই। এর সবই মাশরাফি আমাদের দেন; মাশরাফি অনেক কিছুই আমাদের দেন; মাশরাফি আমাদের সবার জীবনের সেরা এক দাতা! 

জিততে জিততে হেরে গেলে সবাই মুষড়ে পড়ে। চোখের জলে কারো কারো দুঃখ ধুয়ে যায়। সাকিব-মুশফিকরা চোখ মুছেন জার্সিতে। কিন্তু মাশরাফিকে দেখি অবিচল। ভেতরে অঙ্গার হলেও বাইরে তার চাপ পড়তে দেন না তিনি। সবাইকে বুকে নেন, সান্ত্বনা দেন; তাঁকে কেউ সান্ত্বনা দেয় না, সে সাহস বুঝি কারো নেই! মাশরাফির কোনো সান্ত্বনার দরকার নেই। পৃথিবীর কোনো কিছু তাকে এতটুকু টলাতে পারে না। মাশরাফি এতটাই শক্ত, এতটাই পাথর-হৃদয় তাঁর! মাশরাফি যেন একটা পাহাড়। পাথরে পাথরে ভরে আছে তার হৃদয়। কিন্তু গানে তো আছে-‘পাহাড়েরও আছে কান্না’। মাশরাফি এক পাহাড় কান্নাই লুকিয়ে রাখেন নিজের ভেতর। তাঁকে তো দুর্বল হওয়া যাবে না, কোনোভাবেই না, কোনো পরিস্থিতিতেই না! হাঁটুতে সাতটা অস্ত্রোপচার করলেও না।

মাশরাফি একটা নাম, জগতে এ নামের কোনো ক্ষয় নেই। অক্ষয় অমর অব্যয় মাশরাফি, পৃথিবী এইদিনে তোমাকে পেয়েছে বলে আমরা তোমাকে পেয়েছি; আমাদের নেতাকে পেয়েছি, আমাদের ক্যাপ্টেনকে পেয়েছি। শিরোপা নয়, জয় নয়, আমরা ধন্য তোমাকে পেয়ে-জন্মদিনে তোমাকে জানাই অগণিত প্রণতি। জিও যুগ যুগ হে বীর।

লেখক : সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়