মুক্তিযুদ্ধের অনন্য বন্ধু সিডনি শ্যানবার্গ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। সে রাতে পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা শহরে রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে হানাদার বাহিনী সর্বকালের নৃশংস হত্যাকান্ড সংগঠিত করেছিল।
এ ঘটনা এতটাই পরিকল্পিত ছিল যে সেদিন ঢাকায় অবস্থানরত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদেরও জানতে দেওয়া হয়নি। তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনেকটাই বন্দি অবস্থা ছিলেন। তবে কেউ কেউ এর মধ্যেও চেষ্টা করেছেন সে রাতের ঘটনা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে। ঢাকায় অবস্থানরত অকুতোভয় বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকে নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে বিশ্বজনমত তৈরিতে অনবদ্য ভুমিকা রেখে ছিলেন। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তেমনই একজন নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ শ্যানবার্গ। যিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। সে সময় তিনি নিউয়র্ক টাইমসের দিল্লি প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণীঝড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনহানীসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ সংগ্রহ করতে সেসময় তিনি পূর্বপাকিস্তান সফর করেন। সে বছর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সংলাপ খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যে কজন বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন, শ্যানবার্গ ছিলেন তার অন্যতম। ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্সে যেদিন জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, সেদিনও শ্যানবার্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জন পর্যন্ত পূর্বাপর পুরো ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন শ্যানবার্গ।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে নিউইয়র্ক টাইসে শ্যানবাগের্র অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কোনোটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে, কোনোটি দিল্লি বা কলকাতা থেকে। ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে উদ্বাস্তু শিবিরে বহুবার গিয়েছেন। উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অবর্ণনীয় দুর্দশার বিবরণ তার প্রতিবেদনে উঠে আসতো।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে জুন মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ ঠিক করে পুরো দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে, সে কথা প্রমাণের জন্য কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে তাদের প্রহরায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবে। শ্যানবার্গও ছিলেন তাঁদের একজন। সে সফর শেষে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তাঁর প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্যানবার্গের ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। ২ ৫মার্চের আগে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার খবর নিতে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বহুবার যোগাযোগ হয়েছে। সে যোগাযোগ একসময় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে স্বল্প সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। শ্যানবার্গ সেদিন এয়ারপোর্টে ছিলেন। অনেক দুর থেকে তাঁকে দূর থেকে দেখে বঙ্গবন্ধু চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আরে শ্যানবার্গ, তুমি?’ যেন দুই পুরোনো বন্ধু, এমনভাবে তাঁরা সেদিন করমর্দন করেছিলেন।
১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করলেও মিরপুরের কোনো কোনো এলাকায় তখনও কিছু পাকসেনা স্থানীয় বিহারীদের সঙ্গে মিলে বাঙালি নিধন করছিল। এরমধ্যেই ১৮ ডিসেম্বর শ্যানবার্গ গিয়েছিলেন মিরপুরের এক গণকবরে। সেখানে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে শ্যানবার্গ বলেন, ‘মিরপুরের একটি গণকবরে ১২-১৩ বছরের একটি বালকের সঙ্গে দেখা। অপুষ্টি ও অভাবে জীর্ণ শরীর। মাটি খুঁড়ে বানানো বেশ প্রশস্ত গণকবরটির চতুর্দিকে ছুটে বেড়াচ্ছিল ছেলেটি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে খেলা করছে, দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছুটছে, হাতে ছোট একটি খুরপি দিয়ে মাটি খোঁচাচ্ছে।’
‘অধিকাংশ কবর সদ্য তৈরি, মাটি তখনো জমাট বাঁধেনি। মাটিতে হাত ডোবালেই বেরিয়ে আসছিল সদ্য মৃত মানুষের দেহাবশেষ। এই ভুতুড়ে জায়গায় এই ছেলেটি কেন। আর কেনই বা এমন করছে সে? এরপর দোভাষীর কাছ থেকে জানতে পারি, বাবার লাশ খুঁজছে ছেলেটি। সেই ছেলেটিকে আমি এখনো দেখতে পাই, চোখ বুজলেই তার মুখটা ভেসে ওঠে।’ ছোট কয়েকটি কথায় সেদিন মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে যদি সাহায্য দরকার হয়, নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ নিয়ে সাক্ষী হতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
এক লেখায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতা আমার জন্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একাত্তরের গণহত্যা ভালোভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি, সে জন্য আমি সে ঘটনা যতটা সম্ভব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ আমার নিজের দায়িত্ব বলে মনে করি। আমি শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও সাহসিকতার জন্য তাঁকে সম্মান করি। ১৯৭১-এ আমার সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপরাধমূলক ব্যবহারের প্রতি যে সমর্থন দেয়, সে জন্য আমি ঘৃণা বোধ করি।’ তিনি তার লেখা ‘বিয়ন্ড দ্য কিলিং ফিল্ডস’ গ্রন্থে সে সময়ের ১২টি প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
সিডনি শ্যানবার্গ ১৯৩৪ সালের ১৭ জানুয়ারি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি দি নিউইয়র্ক টাইমসে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-এর হত্যাকান্ড তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেসময় তিনি ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হোটেলের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন ইতিহাসের এক ভয়ানক হত্যাকান্ড।
তিনি পুরো যুদ্ধকালে মুক্তিযুদ্ধের ওপর অসংখ্য প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের অবস্থা। তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ। নাম ডেটলাইন বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান। অনুবাদ ও সংকলন করেছেন মফিদুল হক।
দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থেকে ৮২ বছর বয়সে ২০১৬ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু সিডনি শ্যানবার্গ মারা যান। সাহসীকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি মর্যাদার পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন।
ঢাকা/এনএ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন