ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের পরমবন্ধু এডওয়ার্ড কেনেডি

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের পরমবন্ধু এডওয়ার্ড কেনেডি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যেসব বিদেশি সরকার বিরোধিতা করেছে সেসবের মধ্যে যুক্তরাস্ট্রের নিক্সন সরকার অন্যতম। পাক হানাদার বাহিনী নৃশংসভাবে নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালিদের যে হত্যা করেছে তাতে সহায়তা করেছে ওই সরকার।

তবে দেশটির রাষ্ট্রযন্ত্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিলেও সেদেশের জনগন নানা ভাবে বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমেরিকার প্রভাবশালী কেনেডি পরিবারের সদস্য সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাদের অন্যতম।

নিক্সন প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন। আর এ জন্য বিব্রতকর অবস্থা পড়তে হয় নিক্সন প্রশাসনকে। খোদ প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং তার অন্যতম কুবুদ্ধিদাতা হেনরি কিসিঞ্জার নানাভাবে তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এডওয়ার্ড কেনেডির বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কাছে বার বার তাদের হার মানতে হয়েছে।

পাকিস্তান সরকারের হত্যাযজ্ঞ বন্ধে তিনি আমেরিকার সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করার পাশাপাশি দেশের জনগনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বোতভাবে সহায়তা দিতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এছাড়াও বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে তিনি এক অনন্য ভ’মিকা পালন করেন। যুদ্ধচলাকালে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী কেন্দ্র ঘুরে মানুষের দুর্বিসহ কষ্টে নিজে ব্যথিত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আর একই সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার কথা বিশ্বাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

কেনেডি পরিবার আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে বিভিন্নভাবে। সে ক্ষেত্রে সাফল্য ও দুর্ভাগ্য দুই-ই তাদের তাড়িত করেছে। প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি সুদর্শন তরুণ হিসেবে কেবল নয়, রাজনীতিতে নতুন হাওয়া বইয়ে দেওয়ার অন্যতম ব্যক্তি হিসেবেও অনেকের মন কেড়েছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন ভাই রবার্ট কেনেডিকে। বয়সে তিনি ছিলেন নবীন, চেহারায় নবীনতর। অমন এক ভারিক্কি পদে তাঁর মতো হালকা-পাতলা ব্যক্তির নিয়োগ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু রবার্ট কেনেডি নিজ গুণে সেসব মোকাবিলা করেছিলেন, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল তাৎপর্যবহ।

জন কেনেডি ও রবার্ট কেনেডি দুইভাই আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে কনিষ্ঠ ভাই এডওয়ার্ড কেনেডি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তিনি অনেকটা নিস্প্রভ হয়ে পড়েন। এছাড়া ১৯৬৯ সালে বান্ধবীসহ গাড়ি দুর্ঘটনা ঘিরে তাঁকে নানাভাবে সমোলোচিত হতে হয়। দেশে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও ক্ষমতার দৌড়ে তাকে তেমন আগ্রহী দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু সহায়তায় অর্থ বরাদ্দ-সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান।

তবে এই মানুষটির নিজের মধ্যে গভীর এক মানবতাবোধ জাগ্রত ছিল। আর সেখান থেকেই সম্ভবত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় নিজে যেমন অনেকটাই পাল্টে গেলেন, তেমনি ইতিহাস প্রভাবিত করার মতো প্রত্যয়ও প্রদর্শন করলেন। বিশেষভাবে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য রাখলেন বিপুল অবদান। তাইবাংলাদেশ ও এডওয়ার্ড কেনেডির সম্পর্ক এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বহিঃর্বিশ্ব তা জানতে বেশ অনেকটা সময় লেগেছিল। মার্চের উত্তাল দিনগুলোর সংবাদ সংগ্রহ করতে সেসময় বেশ কিছু বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পশুর মত ঝাপিয়ে পরার আগেই সব বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে হানাদার বাহিনী। ফলে বাইরের দুনিয়ায় তাৎক্ষণিক খবরাখবর বিশেষ পৌঁছায়নি। বহিষ্কৃত সাংবাদিকেরা কিছু রিপোর্ট করেছিলেন। সীমান্ত পাড়ি দেওয়া উদ্বাস্তুরা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকি বাহিনীর নৃশংসতার চিহ্ন। আর ঢাকা থেকে মার্কিন কনসাল আর্চার ব্লাডের গোপন রিপোর্টে ফুটে উঠেছিল নৃশংসতার চিত্র।

সেসব সংবাদ এডওয়ার্ড কেনেডিকে বিচলিত করে তোলে। বিভিন্ন সূত্র থেকে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে থাকেন তিনি। এরপর ১ এপ্রিল সিনেটে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত তাঁর প্রথম বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘মাননীয় সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ঘটনার বিপুল জটিলতা আমি অনুধাবন করি। কূটনীতিক ও মানবতাবাদীদের জন্য এ এক জটিল বিষয়। তবে আমাদের সরকার কি এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করবে না? সংঘাতের শিকার হওয়া লাখো মানুষের ভাগ্যবিড়ম্বনা নিয়ে আমরা কি ভাবিত হব না? আমরা কি সহিংসতা রোধে আমাদের উত্তম সেবা দিতে চাইব না, অন্তত তেমন প্রচেষ্টা যাঁরা নেবে তাঁদের সহায়তা করব না?’

এরপরও তিনি বহুবার একই ভাবে বাঙালির পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সিনেটের আঁটসাঁট নিয়মনীতির মধ্যে আলোচনার বিষয় ধার্য হতো বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের সহায়তায় অর্থ বরাদ্দ। কিন্তু তার আলোচনায় উঠে আসত আরও বড় বিষয়। দেশটিতে কেন এই উদ্বাস্তু সমস্যা, নৃশংসতার ধরন ও প্রকৃতি, এর রাজনীতির নানাদিক। ফলে সিনেটের এই কমিটির সভা সাংবাদিকদের জন্যও হয়ে ওঠে আকর্ষণের ক্ষেত্র এবং বাইরের দুনিয়ায় প্রচারিত হয়ে তা ব্যাপকভাবে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করে।

১৯৭১ সালের ১১ মে বিদেশ নীতি-সংক্রান্ত কমিটির শুনানিতে হাজির হয়ে এডওয়ার্ড কেনেডি আবেগপূর্ণ আবেদন জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতির গুরুত্ব উপেক্ষা করার উপায় নেই। মানুষের জীবন, অসহায় জীবন, হাজারো, লাখো জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন, এই বিনাশ গোটা মানবতার বিবেককে দংশন করবে, যদি জীবন বাঁচাতে আমরা পদক্ষেপ না নেই।

শুধু সিনেটে সভায় বক্তৃতা দিয়েই নয় আগস্ট মাসে সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ভারতে উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে আসেন এডওয়ার্ড কেনেডি। ঘুরেছিলেন কলকাতার কাছের লবণ হ্রদের শিবির, যশোর রোড ধরে গিয়েছিলেন বনগাঁ। আরও ঘুরেছেন জলপাইগুড়ি ও আগরতলায়। মানুষের দুর্দশা নিজ চোখে দেখে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ওয়াশিংটন ফিরে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে শরণার্থীশিবিরের মানবেতর অবস্থা, শিশুমৃত্যু এবং অসহায় নারী-পুরুষের যে চিত্র তিনি মেলে ধরেন, তা রাজনীতি ছাপিয়ে মানবতার নিবিড় প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে বাস্তুভিটা ছেড়ে ভারতের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া বাঙালির চরম দুর্দশা দেখে এডওয়ার্ড কেনেডি নতুন রূপে অবির্ভূত হন। ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন। সে জায়গায় তিনি পূর্ববাংলা বলা শুরু করেন। তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন।

এডওয়ার্ড কেনেডির কর্মকান্ড নিক্সন প্রশাসন ভাল ভাবে নেয়নি। তার কাজে বিভিন্ন ভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কেউ যাতে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের কোন ধরনের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে না পারে সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে কোনো কিছুই তাকে তার অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি। সরকার প্রধানের হুমকি সত্ত্বেও নিক্সন প্রশাসনের অনেকেই গোপনে এডওয়ার্ড কেনেডিকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।

এডওয়ার্ড কেনেডি নিক্সন প্রশাসনকে কতটা নাড়া দিয়েছিল তা তার ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সিনেটের অধিবেশনে দীর্ঘ ভাষন প্রমান করে। এদিন তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে নিক্সন প্রশাসনের নীতির সমালোচনা করেন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের উদাহরন টেনে বলেন, ‘আমরা জানি পূর্ব বাংলার মানুষ নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। সামরিক আইনের আওতায় অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হয়। এটা ছিল গণতান্ত্রিকভাবে আয়োজিত নির্বাচন, যা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ম্যান্ডেট তাঁকে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো, কেননা তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। এখন নিজেদের আমরা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছি, যারা তাঁকে বন্দী করেছে। এমনই এক অবাধ স্বাধীন নির্বাচনের জন্য ৫৫ হাজার আমেরিকান মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে ভিয়েতনামে। আর আমরা সেই শাসকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, যারা নির্বাচিত নেতাকে আটক করেছে কারাগারে।’

তিনি বলেন,‘পূর্ব বাংলার জনগণের ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের ট্র্যাজেডি নয়, এটা হচ্ছে গোটা বিশ্ব সমাজের জন্য ট্র্যাজেডি। আর এই সংকট মোচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার দায়িত্ব সবার।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির জন্য ছিল বিশেষ আনন্দবহ। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য সিনেটর স্যাক্সবি উত্থাপিত প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। বাংলাদেশের বিজয়ে তিনি দেখেছিলেন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।

সিনেট বৈঠকে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশকে আমেরিকার অনেক আগেই স্বীকৃতি দেয়া উচিত ছিল। আমি মনে করি, প্রশাসন যেভাবে উপমহাদেশের সংকট মোকাবিলা করেছে, তা ছিল সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বিদেশনীতির সবচেয়ে বড় ভুল। সময় এসেছে আমাদের নীতি পরিবর্তন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার, যে স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইনের যে কোনো বিচারে তাদের প্রাপ্য। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে ও মনেপ্রাণে এই ইঙ্গিত দিয়েছে এবং প্রায় সর্বজনীনভাবে তাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছে যে তাদের স্বাধীন হতে হবে।’

এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর পাশবিকতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। প্রায় দুই কোটি শরণার্থীর দুর্দশা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে কেনেডি সিনেট জুডিশিয়ালি কমিটির কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছিলেন ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’ নামে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই রিপোর্টটি অনেক গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এডওয়ার্ড কেনেডি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে আসেন। এখানে তিনি একটি শোভাযাত্রায় অংশ নেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। এডওয়ার্ড কেনেডির জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ এবং  ২০০৯ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরন করলে বাংলাদেশ হারায় মুক্তিযুদ্ধের পরমবন্ধুকে।

 

ঢাকা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়