ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন যেন নিমিষেই গায়েব’

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন যেন নিমিষেই গায়েব’

ডা. সুকেশ চন্দ্র রায়

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : ‘কোনো সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেইনি। মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন যেন এক নিমিষেই গায়েব।’

বুকভরা কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে স্ক্র্যাচে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে এভাবেই রাইজিংবিডিকে কথাগুলো বলছিলেন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা (ম. ৮২৭৮৬) দাবি করা ডা. সুকেশ চন্দ্র রায় (৭৭)।

তিনি বলেন, ‘যখন মুক্তিযুদ্ধ হয়, তখন একটি শপথই নিয়েছিলাম দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। নিজের জীবন বিপন্ন করেও স্বাধীনতা অর্জনে ছুটেছিলাম। আমরা কি জানতাম, যুদ্ধের পর আমরা বেঁচে থাকলে কতটুকু সুযোগ সুবিধা পাবো।’

সুকেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘যুদ্ধের সময়ে শুধু দেশের কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা নিয়ে। দু’দুবার গেজেটভুক্ত হয়েও বৃদ্ধ বয়সে যাচাই-বাছাই পরীক্ষাটি যেন আমার সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এখন হয়তো রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লাল-সবুজের পতাকাটি বুকে নিয়ে মরতেও পারবো না।’

ডা. সুকেশ চন্দ্র রায় দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতের বড়ছড়া ক্যাম্পে চলে যান তিনি। পরে সেখানে পানছড়া, মনাই ও বালাট ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে তার দেখা হয়। তখন বিভিন্ন ক্যাম্পে কলেরার পাদুর্ভাব দেখা দেয়। বলাট ক্যাম্পের জয়বাংলা কার্যালয়ে গেলে এমএনএ আবদুল কদ্দুস মোক্তার তাকে রণাঙ্গনে না গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। এ সময় ওই কার্যালয়ে আবদুল হামিদও উপস্থিত ছিলেন। আর সেখানেই তিনি ছয়-সাত মাস আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটির দৃষ্টিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা না। তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এ মুক্তিযোদ্ধাকে।

তিনি জানান, যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে যেসব কাগজপত্র তিনি জমা দিয়েছিলেন সেসব কাগজপত্র তারা দেখেনি। তাকে এক মিনিটও তার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কিন্তু তালিকা প্রকাশের শিটে আবেদনপত্র ছাড়া তার কোনো কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

তিনি বলেন, ‘আমাকে কোনো প্রশ্নই করা হয়নি, তাহলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে যাচাই-বাছাই করা হলো, আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। এখন শেষ ভরসা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) আপিল করা।’

বয়সের ভার আর অসুস্থতাকে সঙ্গী করে গত ৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সকল প্রমাণাদি সঙ্গে নিয়ে জামুকাতে আপিল করেন তিনি। কিন্তু দুশ্চিতা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না।এখন শুধুই অপেক্ষার পালা, কবে জানতে পারবেন তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।

শুধু তিনি নয়, গেজটভুক্ত বহু মুক্তিযোদ্ধাকে যাচাই-বাছাইয়ে বাদ দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে এ যাচাই-বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে। যাচাই বাছাই শেষ যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকা ছিল, এমন ব্যক্তিরও নাম উঠেছে। এক অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শহরের আখড়াবাজার এলাকার বাসিন্দা কাজী সেলিম খানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়ে ২০১০ সালে অভিযোগ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সঙ্গে পাকসেনাদের ঘনিষ্টতা নিয়ে জাতীয় দৈনিক কালেরকণ্ঠ, সমকাল ও যুগান্তরের মত পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু এবার যাচাই বাছাই কমিটি তাকেও কবুল করে নিয়েছে।

যাচাই-বাছাই পর্বে বাদ পরা মুক্তিযোদ্ধারা রাইজিংবিডিকে জানান, কমিটির যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াতে মারাত্মক ত্রুটি ছিল। তারা বহু মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষীদের কথা শুনেননি, কাগজপত্রও ঠিকমতো দেখেননি। যে নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল, তা মানা হয়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধারা যেসব সাক্ষী নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হয়েছিলেন, সেই সাক্ষীদের কথা পর্যন্ত শোনা হয়নি।

তারা আরো জানান, অনেক মুক্তিযোদ্ধা বয়সের ভারে এখন ঠিকমত কথা বলতে পারেন না-হাঁটতেও পারেন না। আপিল বা রিট করার মত সামর্থ্য সবার নেই। অনেক দুঃস্থ অসহায় মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যাদের আর্থিক অবস্থাও ভাল নেই। সকল কাগজপত্র থাকা স্বত্ত্বেও তাদের পক্ষে জামুকায় আপিল করার জন্য ঢাকা পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সরকার তাদের জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, সেদিকেই তারা চেয়ে আছেন।

সূত্র মতে, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় নতুন আবেদন ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিয়ে মোট ২৯৩ জন যাচাই বাছাইয়ের আওতায় আসে। এর মধ্যে মাত্র ৪৮জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যাচাই-বাছাই কমিটি। যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত তালিকা উপজেলা পরিষদের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. আসাদুল্লাহকে সভাপতি ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসউদকে সদস্য সচিব করে গঠিত সাত সদস্যের কমিটি এ যাচাই-বাছাই করেন।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সদর উপজেলা কমান্ডার অ্যাডভোকেট মো. মতিউর রহমান, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি ভূপাল চন্দ্র নন্দী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আবু বক্কর ছিদ্দিক, জামুকার প্রতিনিধি মফিজ উদ্দিন ও জেলা কমান্ডের প্রতিনিধি বাশির উদ্দিন ফারুকী।

যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য সচিব সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসউদ বলেন, ভারতে গিয়ে যারা ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যাচাই-বাছাইয়ে সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের আমলে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।

যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য ভূপাল চন্দ্র নন্দী বলেন, ‘জেনুইন মুক্তিযোদ্ধারা যদি কোনো কারণে বাদ পড়ে থাকে তাহলে তো আপিল করার সুযোগ দেওয়াই আছে।’

অমুক্তিযোদ্ধা কাজী সেলিম খানের প্রসঙ্গে উনি বলেন, ‘অবশ্যই তার কোনো ডকুমেন্ট টকুমেন্ট হয়তো দাঁড়া করাইছে, যার কারণে অইছে। না অইলে তো অইত না।’

কমিটির আরেক সদস্য মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘৪৩ বছর পরে একটা যাচাই বাছাই হচ্ছে, এখানে সমস্যা তো থাকতেই পারে। এতে ভালো (প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা) কেউ বাদ পড়ে যেতে পারে। খারাপও (অমুক্তিযোদ্ধা) তালিকাভুক্ত হয়ে যেতে পারে। এটাতো খুবই স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কিছু না।’

এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. আসাদউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর এসএমএস পাঠিয়েও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি কয়েকবার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিসে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।



রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/রুমন চক্রবর্তী/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়