ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ছোটগল্প || মুজিবনগরে আমবাগানে

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৯, ১৭ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || মুজিবনগরে আমবাগানে

মুন্সি কফিলউদ্দিন ট্রানজিস্টার শোনেন না। ফজরের নামাজ পড়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েন। নিয়মিত অভ্যাস। ঘুম থেকে জেগে ওঠেন সূর্য ওঠার পর। উঠেই স্ত্রীর দেয়া খাবার  খেয়ে কাজে  বেরিয়ে পড়েন। কাজ তেমন কিছু না। বাজারে একটা হোমিওপ্যাথির দোকান আছে, স্ত্রীর নামে রাখা- রীমা হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্র। নিজেই ডাক্তার। নিজেই কম্পাউন্ডার। এমন কী ছোট দোকানটার ঝাড়ামোছাও তিনিই করেন।

স্ত্রীর দেয়া পান্তাভাত আর গতরাতের তরকারি মেখে খাওয়া সেরে বাজারে চলে এসেছেন। মুন্সি বাজারে এসে দেখলেন, এরফানের চায়ের দোকানে লোকজনের ভীড়। চায়ের দোকানটা রীমা হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্রের ঠিক বিপরীতে। লোকজন ফিসফিস কথা বলছে আর ট্রানজিস্টার শুনছে। কিন্তু কী শুনছে বুঝতে পারছেন না কফিলউদ্দিন। একটা কিছু শুনছে, দূর থেকে অনুমান করছেন। চিকিৎসা কেন্দ্রের দরজা খুলে আর অপেক্ষা করেন না মুন্সি। ধীর পায়ে হেঁটে এরফানের চায়ের দোকানে গেলে, ট্রানজিস্টারে শুনতে পান হামদ নাত হচ্ছে। এরফানের মুখে ভয়, ভাই! আপনেরা যান। আমি দোকান বন্ধ করুম।

দোকান বন্ধ করবেন ক্যান? জিজ্ঞেস করে মুন্সি।

আপনে খবর শোনেন নাই?

কী খবর?

শেখ সাবরে মাইরা হালাইচে।

কোন শেখ সাবরে মারছে?

কয়জন শেখ সাবরে চেনেন এই বাংলায়?

মুহূর্তে মুন্সীর করোটিতে ধরা পড়ে- এই বাংলায় শেখ সাবতো একজনই। তিনি শেখ মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধু।  সেই মানুষটিকে মেরেছে! কারা করলো এই জঘন্য কাজ? মুন্সি কফিলউদ্দিন মাথা নুইয়ে এরফানের আরও কাছে এগিয়ে যায়, কারা মারলো শেখ সাবরে?

এরফানের বলার আগেই ট্রানজিস্টারের নাত থেমে যায়। মুন্সিসহ সবাই শুনতে পায় ট্রানজিস্টারে ভেসে আসা তরঙ্গে- আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। সঙ্গে আছে জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি সরকার প্রধান হিসেবে কিছুক্ষণের মধ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ  দেবেন।  আপনারা অপেক্ষা করুন।

খোন্দকার মোশতাক আহমেদ! নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মুন্সি ঘৃণায় থুথু ফেলেন, আমি হেইদিনই কইছিলাম আমাদের কমান্ডারকে। কিন্তু কমান্ডার পাত্তা দেয় নাই। আজ আমার কথাটা ঠিক হইলো তো। চোখে মুখে কাতরতা  ফোটে মুন্সি কফিলউদ্দিনের।

কেদারগঞ্জ বাজারে সকালের চা পান করতে আসা লোকজন আশপাশেরই। সবাই পরিচিত।ট্রানজিস্টারের ঘোষণায় লোকজন বিব্রত। খানিকটা হতভম্বও। এই দেশে শেখ মুজিবকে কেউ মেরে ফেলতে পারে, চিন্তাও করতে পারে না তারা।  বিব্রত পরিস্থিতির মধ্যে জনসাধারণের মনে প্রশ্ন ওঠে, কেনো মেরেছে? তাকে কী একা মেরেছে? নাকি আরও কেউ...।  ঢাকার পরিস্থিতি এখন কেমন? উপস্থিত মানুষের ভাবনার মধ্যে মুন্সিকে আপন মনে কথা বলতে দেখে তাকায় হাতেম আলী- ও মুন্সি  নিজের মনে কী বলতেছো?

তোমার মনে আছে কাকা?

কী?

ওই যে আমরা মুজিবনগর সরকারের শপথ নেয়ার দিন বাংলাদেশ সরকাররে স্যালুট দিছিলাম।

মনে থাকবে না ক্যান? উত্তর দেয় হাতেম আলী, সেইদিন কী ভোলা যায়? কী উত্তেজনা। কী ভয়। যে কেনো সময় পাকিস্তান আর্মীর যুদ্ধ বিমান আমাগো উপর আক্রমণ করতে পারে, এই ভয় আর তরাসের মইধ্যে তাজউদ্দীন, ক্যাপটেন মনসুর, সৈয়দ নজরুল ইসলাম আইলো কয়েকটা গাড়ি বোঝাই হয়ে। সঙ্গে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা...।

আমাগো তো মুজাহিদের ট্রেনিং ছিল। আমাগো ডাকলো ঝিনাইদহের পুলিশসুপার মাহবুব সাব। মুজিবনগর সরকারের শফত নেয়ার পর আমরা মাহবুব স্যারের নির্দেশে পোষাক পইরা প্যারেট করলাম। মুজির নগর সরকাররে গার্ড অব অনার দিলাম। সেই সরকারের মোশতাক আহমেদরে দেইখা আমি একটা কতা কইছিলাম, তোমার মনে আছে?

মাথা নাড়ায় হাতেম আলী, সব মনে আছে। তুমি কইছিলা সবাই পইরা আছে সাদা পোষাক, পাজামা পাঞ্জাবি। আর খোন্দকার পইরা আছে লম্বা একখান টুপি আর কালা কোট আর কালা প্যান্ট। হের মাথার টুপিটাও আছিল কালা। মোশতাকের চোখের চশমাও ছিল কালা। তুমি কইলা এই লোকটা বদ।

আমার হেই দিনের কথার প্রমাণ পাইলাতো?

মাথা নাড়েন হাতেম আলী, তোমার কথাই সত্যি হইলো আউজ। তয় হুনছি, বঙ্গবন্ধু নাহি হেরে খুব পছন্দ করতো?

আমিও হুনছি।

মুন্সি কফিলউদ্দিন আর হাতেম আলীর কথার মধ্যে এরফান ঘোষণা করে, আপনেরা যার যার বাড়ি যান। দেশের অবস্থা ভালো না। আমি দোকান বন্ধ করুম।

কেদারগঞ্জ বাজারে লোকজন নেই বললেই চলে। যে কয়জন জমা হয়েছে, সবাই এরফানের চায়ের দোকানে। এরফানের ঘোষণার পরে লোকজন যে যার মতো চলে যায়। মুন্সি এসে বসেন রীমা হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্রে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে, শরীরের মধ্যে এক ধরনের অকিথত জ্বালা জ্বলছে। কেউ কোথাও নেই, কারো সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাবে? শেখ মুজিব- যার উপাধী বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা... সেই তালগাছের মতো উঁচা লম্বা মানুষটারে কেমনে মারলো? গুলি করে মারছে? নাকি চাকু দিয়া? বঙ্গবন্ধুরে যখন মারছে, তখন কী কথা বলেছিল?

সূর্য অনেকটা মাথার উপরে চলে এসেছে। মুন্সি কফিলউদ্দিন ভাবনার মধ্যে কোনো মিল না পেয়ে দাঁড়ায়। ঠিক সেই সময়ে ভেতরে ঢোকে অমর রিচার্ড মন্ডল। কেদারগঞ্জ বাজার থেকে রিচার্ডের বাড়ি বেশি দূরে না। সময় পেলে মুন্সির কাছে এসে গল্প করে।

মন্ডলকে দেখে মুন্সি জানতে চায়- খবর শুনেছো মন্ডল?

শুনেই তো এলাম তোমার কাছে। কার বুকের এতো বড় পাটা- বঙ্গবন্ধুরে হত্যা করে?

কেমনে বলবো? জবাব দেয় মুন্সি, তুমিই যে কেদারগঞ্জে আমিও সেই গঞ্জে। ট্রানজিস্টারে কেবল একটা লোকের গলা হুনলাম, বললো, আমি মেজর ডালিম বলছি। এই ডালিম খুনিটা কে?

জীবনে নাম হুনি নাই।

দুজনে বিমর্ষমুখে বসে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা নাই। নীরবতা ভাঙ্গে অমর, মুন্সি চলো একটা পান খাই।

পান কই পাইবা? কেদারগঞ্জ কেউ নাই। সবাই দোকান বন্ধ কইরা বাড়িতে গেছে।

আমিও যাই।  অলস ভঙ্গিতে দাঁড়ায় অমর রিচার্ড মন্ডল। মনের মইধ্যে কেমন জানি করে ডাক্তার। খবরটা শোনার পর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। দরজার বাইরে পা বাড়াতেই ডাকে মুন্সি, মন্ডল?

ফিরে দাঁড়ায়, কী বলবে বলো।

একটা কাজ করা যায় না? গভীর আগ্রহ মুন্সির কণ্ঠে।

কী কাজ?

আমি, তুমি এই মুজিবনগরের সন্তান। আমিতো মুজিবনগর সরকারকে স্যালুট দিছি। মুজিবনগরের আমবাগানে যেখানে সরকার শপথ নিয়েছিল, ঠিক সেইখানে বঙ্গবন্ধুর জন্য জানাজা পড়লে কেমন অয়?

শরীরে বিদুৎ খেলে যায় অমর রির্চাড মন্ডলের। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক তাকিয়ে থাকে হোমিও ডাক্তার মুন্সি কফিলউদ্দিনের দিকে। দরজা থেকে ফিরে এসে বসে মুন্সির সামনে, তুমি যে বঙ্গবন্ধুর জন্য জানাজা পড়বা, কারে লইয়া পড়বা?

এই এলাকার মানুষদের লইয়া পড়বো।

মানুষ কী জানাজা পড়তে আসবে?

বলো কী রির্চাড? বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়তে আসবে না? আমি বললে নিশ্চয়ই আসবে। এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য মানুষটা সারা জীবন লড়াই করলো, বছরের পর বছর জেল খাটলো, দেশটাকে স্বাধীন করলো, আর সেই মানুষটার জন্য এইটুকু করতে পারবো না?

কথা তো ঠিকই কিন্তু কখন পড়াইবা?

এলাকার লোকজনরে জানাবো। লোকজন আসলেই পড়বো।

লোকজনরে জানাতে হলে এখনও বসে আছো কেনো? এমনিই ভয়ে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। এখনই বের হও।

ঠিকই বলেছো, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় মুন্সি কফিলউদ্দিন। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দুজনে বাইরে আসে। বাজারের মধ্যে যেতেই দেখা দোকানদার হাফিজুদ্দিনের সঙ্গে। হাফিজুদ্দিনের ঘরে ডাল আর পিঁয়াজ নেই। সেগুলো নিতে এসেছে। মুন্সি আর মন্ডলকে দেখে ফিসফিসিয়ে বলে, বাজারে থাইকো না। বাড়ি যাও। শুনছি মিলিটারি নামতে পারে যে কেনো সময়ে।

নামে নামুক। গুরুত্ব দেয় না  মুন্সি, হাফিজ ভাই একটা কাজ করতে চাই।

দোকান থেকে ডাল আর পিঁয়াজ একটা ব্যাগে নিয়ে দোকানের দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে ফিরে তাকায়, কী কাজ?

বঙ্গবন্ধুরে তো মাইরা ফালাইচে, লগে কালা প্যান্ট আর কালা পাঞ্জাবি পরা কালা খোন্দকারও আছে। আমাদের এইখানেই তো মুজিবনগর। যেখানে আমরা মুজিবনগর সরকাররে স্যালুট দিছি, সেই মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধুর জন্য গায়েবানা জানাজা পড়তে চাই।

কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে হাফিজউদ্দিন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর্দ্র কণ্ঠে বলে, তুমি একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছো ভাই। কিন্তু জানাজা পড়তে হলে তো আরও লোক লাগবে। তাছাড়া জানাজা পড়াবে কে?

আমি। আমি পড়ামু।

ঠিক আছে। তুমি  আরও মানুষজনরে কও। আমি বাড়িতে ব্যাগটা রাইখা আমার পোলা দুইডারে লগে লইয়া আসি।

দারুণ খুশি রিচার্ড আর মুন্সি। হাফিজউদ্দিন সামনের দিকে হাঁটতে গিয়ে আবার ফিরে তাকায়, তুমি একটা কাম করো। এইতো মাইলখানেক দূরে এমপি সাহেবের বাড়ি। আমি গত রাইতে একটা কামে গিয়েছিলাম ওনার কাছে। বাড়িতে আছে। তারেও যাইয়া বলো। এমপি আসলে মানুষজন আরও আসবে।

ভালো কথা কইছেন আপনে- মুন্সি হাত ধরে মন্ডলের, লও একটা দৌড় দিই।

দুজনে দৌড়ে এমপির বাড়ির সামনে গিয়ে হাপাতে থাকে। এমপির বাড়ির সামনে বেশ কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা আর  ভয়। এইসব মানুষদের কাউকে চেনে না মন্ডল কিংবা মুন্সি। মুন্সি পরিচিত মুখের  জন্য চারদিকে তাকায়। এমপি বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। পিছনে কয়েকজন  মানুষ। মুন্সি আর মন্ডল দৌড়ে এমপির সামনে দাঁড়ায়। এমপি ভয় মিশ্রিত চোখে থমকে দাঁড়ায়, তোমারা কারা?

আমরা  কেদারগঞ্জ থেকে এসেছি স্যার, কাচুমাচু হয়ে উত্তর দেয় মুন্সি।

কেদারগঞ্জ? ওদিকে কী মিলিটারি  নেমে গেছে? এমপির চোখের মণি ভয়ে সাদা। মনে হচ্ছে, বাতাসের চেয়েও দ্রুত কাঁপছে লোকটা।

না স্যার। ওদিকে কোনো মিলিটারি নামে নাই, অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বলে অমল।

এসেছো কেনো তোমরা?

স্যার আমরা মুজিবনগরে একটা জানাজা পড়াইতে চাই বঙ্গবন্ধুর নামে। আপনি তো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মানুষ, আমাগো এলাকার এমপি। আপনি জানাজায় শরীক হলে মানুষের মনে সাহস আসবে আর বঙ্গবন্ধুর আত্মাও শান্তি পাবে। আমরা মুজিবনগরের মানুষ, বঙ্গবন্ধুর এই নির্মম মৃত্যুতে যদি এইটুকু না করি...।

হারামজাদা! আগে তোর আত্মার শান্তির ব্যবস্থা করি... এমপি ক্রোধে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পরে মুন্সি কফিলউদ্দিনের উপর। হঠাৎ একের পর এক থাপ্পরে দিশেহারা মুন্সি। ভয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাঁপছে অমর রিচার্ড মন্ডল। এমপির সঙ্গে ছিল পুত্র এবং জামাতা। তিনজনের কিল থাপ্পর আর লাথিতে প্রায় অবশ মুন্সি মাটিতে পরে গেলে, ওরা ছেড়ে দেয়। এমপি একটা লাথি মেরে বাড়ির লোকজনদের নির্দেশ দেয়, এটাকে বাড়ির বাইরে রাস্তার উপর ফেলে আয়।

এমপিপুত্র জামাতাসহ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় নিরপদ আশ্রয়ের জন্য। যেতে যেতে বলে, হারামজাদার সাহস দেখছোস? জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, আর্মীরা কখন কাকে ধরে, মারে ঠিক আছে, উনি আসছেন জানাজা পড়ার দাওয়াত নিয়ে। শুয়োরের বাচ্চা তোর জানাজা কে পরে ঠিক নাই...।

দ্রুত হাঁটার কারণে এমপি’র পরের কথাগুলো আর শুনতে পারে না মুন্সি কফিলউদ্দিন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অমর রিচার্ড এসে হাত ধরে- ভাই ওঠেন।

কোঁকাতে কোঁকাতে দাঁড়ায় মুন্সি। কোমড়টা নাড়াতে পারছে না। মুখের পাশ বেয়ে রক্ত পরছে। ঘুষির আঘাতে মুখের চামড়ার সঙ্গে দাঁতের ঘর্ষণে মুখের ডান পাশের চামড়া ফেটে দরদর রক্ত পরছে। পাঞ্জাবির হাতায় রক্ত মুছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় মন্ডলের কাঁধে ভর দিয়ে।

মুন্সি, এখন কী করবা?

কেদারগঞ্জ বাজারে তো যাই... যদি লোকও পাই, রক্তাক্ত শরীরেও দৃঢ় গলায় বলে মুন্মি কফিলউদ্দিন, বঙ্গবন্ধুর নামে আমি মুজিবনগরে জানাজা পড়াবোই।

আমিও তোমার লগে আছি, পিঠে হাত রেখে অভয় দেয় অমর রিচার্ড মন্ডল।

তাইলে আর কী? জোরে হাঁটো। হাফিজ ভাই যদি আরও লোকজন ডাকতে পারে, জানাজা পড়ানো যাবে। রক্তাক্ত শরীরে, কোমড়ে ব্যথা নিয়ে রির্চাডের কাঁধে ভর দিয়ে দ্রুত হাঁটে মুন্সি কফিলউদ্দিন। যতো দ্রুত হাঁটে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে সূর্য মাথার উপর উঠছে।

এমপি’র বাড়ি থেকে কেদারগঞ্জ যেতে যেতে পথে ডাক্তার গোবিন্দ রায়ের বাড়ি। মন্ডল জোর করে মুন্সিকে নিয়ে ঢোকে ডাক্তারের বাড়ি। গোবিন্দ রায় এক সময়ে সরকারি ডাক্তার ছিলেন। এখন অবসর নিয়ে বাড়িতে আছেন। কেউ অসুস্থ হয়ে বাড়িতে এলে চিকিৎসা দেন। কিন্তু ডাক্তারের বাড়িতে ঢুকে অবাক, কেউ নেই। সামনের দরজায় বড় একটা তালা। রিচার্ড বড় ঘর পার হয়ে পিছনের দিকে আসতেই দেখতে পায় গোয়াল ঘরের পাশে গরুগুলো ঘাস খাচ্ছে। উঠোনে, রান্নাঘরের পাশে মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে। রান্নাঘরে, পুকুরঘাটে হাড়িপাতিলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে  আছে। বোঝা যায় বাড়িতে মানুষ আছে। সামনের দরজায় তালা দেয়া লুকিয়ে থাকার কৌশল। রিচার্ড পিছনের দরজায় কড়া নাড়ে, দাদা আমি রিচার্ড। দরজা  খোলেন। জরুরি কাজ আছে গোবিন্দ দাদা!

কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়ানো গোবিন্দ রায়। সত্তুর বছরের লম্বা সুঠাম শরীরের মানুষটি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেমন মিইয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, রায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোনো জল্লাদ। একাত্তরের রণক্ষেত্রের যোদ্ধা গোবিন্দ রায় মুষড়ে পরেছেন এক সকালের রক্ত ঝড়ে। হাত ধরে রিচার্ড, বাইরে আসুন দাদা। জরুরি কাজ আছে।

কী জন্য এসেছো?

আদাব দাদা, আমি মুন্সি কফিলউ...

হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেন, তোমাকে চিনি। তুমি মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে সালাম দিয়েছিলে না?

যন্ত্রণাকাতর মুখে হাসি মুন্সির, জি দাদা। আপনার মনে আছে?

ওই ঘটনা কী ভুলে যাওয়া যায়? কিন্তু এখন দেশে কী হয় বুঝতে পারছি না।  এই সময়ে আমার কাছে কেনো?

দাদা, মুন্সি আহত হয়েছে, ওকে একটু চিকিৎসা দেন। জরুরি কাজ আমাদের-

একটু অপেক্ষা কর.. গোবিন্দ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন। বাড়ির মধ্যে কোনো মানুষের সাড়া শব্দ নেই। কোথায় গেলো মানুষগুলো? মুন্সির ভাবনার মধ্যে ঘরের ভেতর থেকে ডাক্তারের চামড়ার ব্যাগ নিয়ে আবার সামনে এসে দাঁড়ান। একটা জলচৌকি দেখিয়ে মুন্সিকে বসতে বলে নিজে ব্যাগ খুলতে থাকেন। ব্যাগ খুলতে খুলতে মুন্সির চিকিৎসা করতে করতে সব শোনেন তিনি। মুন্সির কোমড়ে একটা ইনজেকশন দিয়ে দুটি ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে বলেন, আধাঘণ্টার মধ্যে ব্যথা চলে যাবে। তবে আরও কয়েক দিন ওষুধ খেতে হবে।

ঠিক আছে দাদা, পকেটে হাত দেন মুন্সি, কতো দেবো?

জিহ্বায় কামড় দিয়ে ডাক্তার গোবিন্দ রায় বলেন, একবারও বলবে না ও কথা। চলো, উঠে দাঁড়ান ডাক্তার গোবিন্দ রায়। তোমাদের আর অপেক্ষা করা উচিৎ নয়। অনেক বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছো তোমরা... চলো চলো... গোবিন্দ ব্যাগ রেখে ওদের আগেই হাঁটতে শুরু করেন।

দাদা, আপনি কোথায় যাবেন?

সৌম্য মুখে মৃদু হাসি ফোটে গোবিন্দ রায়ের, তোমরা এতো বড় একটা কাজ করছো, সঙ্গে আমি যদি না থাকি বাঙালি হিসেবে  আমার মুখ থাকে? যে  নেতার নির্দেশে যুদ্ধে গেলাম, যুদ্ধ করলাম,  দেশ স্বাধীন করলাম, আজ সেই  নেতার মর্মান্তিক মৃত্যুর দিনে জানাজায় অংশ নেবো না?  হাত ধরেন তিনি মুন্সি  কফিলউদ্দিনের, জানি না বাঙালির বড় দুঃখের দিন আজ। তবে তুমি যে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছো সেজন্য তোমাকে সালাম ।

কী যে বলেন না দাদা! আবেগে আপ্লুত মুন্সি,  আমি একা না। এই কাজে আমার এই বন্ধুটা অমল রিচার্ড মল্ডল, বাজারের দোকানদার হাফিজ ভাইসহ আরো অনেকে অংশ নিচ্ছে। সবাই মিলে প্রতিবাদ করলে খুনীরা ভয় পাবে, বুঝতে পারবে, এই বাংলায় শেখ মুজিব একলা না।

খুইব সাহস পেলাম। সকালে রেডিওতে  হারামজাদা খুনিটার গলা শোনার পর থেকে খুব ভয়ে ছিলাম, কখন কী হয়! রাজাকারেরা তো এখনও জীবিত, চারপাশে ঘোরে। ভয়ে দরজা জানালা আটকে পিছনে চুপচাপ বসে ছিলাম, তোমারা আসায় বাইরে এলাম। আজ যদি তোমাদের সঙ্গে না যাই মরণের পরে শেখ মুজিবের কাছে আমার সন্তানেরা  মুখ দেখাতে পারবে? আমি মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধে গিয়েছি। আজ এই দিনে আমি তাঁর জানাজায় থাকবো না? হাত ধরেন রিচার্ড আর মুন্সির, হাতে সময় নেই চলো।

তিন জনে দ্রত বের হয়ে আসেন সামনের রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে যায় সুরেশ মিস্ত্রি. খায়রুল, রফিকুর আর জয়নালের সঙ্গে। শেখ মুজিবের জানাজার খবরে ওরাও সঙ্গী হয়। সূর্য মাথার উপর যখন ঠিক তখনই কেদারগঞ্জ বাজারে হাজির একটা ছোটখাট দলটি। সেই দলের সঙ্গে যুক্ত হয় হাফিজউদ্দিনের সঙ্গে অপেক্ষায় থাকা আরও দশ বারোজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশ একটা জটলা। জটলা দেখে কেদারগঞ্জে আরও লোক জমা হয়। শেখ মুজিবের নামে মুজিবনগরের আমবাগানে জানাজার আয়োজন হচ্ছে, জেনে কিছু মানুষ বেশ উৎসাহিত। আবার কিছু মানুষ ঠিক উল্টো। সেই  উল্টো মানুষদের একজন আওলাদ মোল্লা। একাত্তরের জামাতের নেতা। পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এলাকার অনেক হিন্দু মুসলমানদের বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের মোল্লা। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে গ্রেফতার হয়ে জেলে ছিল দু্ই বছর। কয়েক দিন হলো জামিনে বাইরে এসেছে। আওলাদ মোল্লার জন্য আজকের সকালটা ঈদের বারতা নিয়ে এসেছে। রেডিওতে  শেখ মুজিব হত্যার ঘটনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে স্ত্রীকে বলেছে, হাঁস রান্না করতে। পেট ভরে গরম ভাত খেয়ে পান চিবাতে চিবাতে কেদারগঞ্জ বাজারে এসে যখন শোনে, শেখ মুজিবের নামে গায়েবানা জানাজা হবে, তখন মাথাটার ভেতরে আগুন লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়, থানা পুলিশদের ঘটনাটা জানানো দরকার। দৌড়ে বাড়ি এসে বড় ছেলে আয়চান মোল্লাকে সাইকেল নিয়ে মেহেরপুর থানায় পাঠিয়ে দিয়ে আবার আসে বাজারে।

ইতিমধ্যে বাজারে প্রায় শতিনেক লোক জড়ো হয়েছে। বাজারজুড়ে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পরেছে। মুন্সি, রিচার্ড, হাফিজ, গোবিন্দ রায় মিছিল করে সামনের দিকে দাঁড়ায়। মিছিল এখনই যাত্রা করবে মুজিবনগরের আমতলার দিকে। কেদারগঞ্জ বাজার থেকে মুজিবনগরের আমাবাগানের দূরত্ব মাত্র মাইলখানেক। মিছিল চলতে শুরু করেছে, মিছিলের পিছনে এসে যুক্ত হয় আওলাদ মোল্লা। আওলাদ মোল্লাকে দেখে মিছিলের লোকজন বিস্মিত। বিস্ময়ের পর বিস্ময় জন্ম দিয়ে আওলাদ মোল্লা পাশের হরমুজ মিয়ার কানে কানে বলে, ওই মিয়ারা জানাজা যে পড়তে যাইতেছো সরকারের হুকুম আছে?

ঘাড় নাড়ে হরমুজ মিয়া, আমি জানি না।

আমি জানি, দৃঢ়ভাবে বলে আওলাদ- পুলিশ আসতেছে।

পুলিশ!

মাথা নাড়ায় আওলাদ মোল্লা, হ্যাঁ পুলিশ। এখন তো মুজিবের সরকার ক্ষমতায় নাই, মইরা শেষ। নতুন সরকারের অনুমতি ছাড়া জানাজা পড়লে জেলে লইয়া যাবে।

মুক্তিযোদ্ধা হারুন পাশে হাঁটতে হাঁতে শুনছিল আওলাদ মোল্লার বয়ান। মেজাজ সপ্তমে উঠলে হারুনকে আটকানো মুশকিল। এই মুহূর্তে তার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেছে। আওলাদ মোল্লার ঘাড় ধরে- হারামজাদা! তোরে আইজ মাইরা হালামু।

মিছিলের শেষ দিকের শোরগোল মিছিলের মাথাও পৌঁছে যায়। দ্রুত ছুটে আসে মুন্সি। ততক্ষণে মাটির সঙ্গে থেতলে গেছে আওলাদ মোল্লার ডান গাল, চিবুক আর কানের লতি।

হারুন ভাই একটা বড় কাজে যাচ্ছি, শক্তি দিয়ে হারুনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে মুন্সি। এখন কী মারামারি করার সময়?

দাঁতে দাঁত ঘষে হারুন, আপনি জানেন না, হারামজাদা কী বলছে?

কী বলছে?

বঙ্গবন্ধুর জানাজা পরতে নাকি সরকারের অনুমতি লাগবে। আর আমাদের জানাজার খবর হারামজাদা  মেহেরপুরের পুলিশদের জানিয়েছে।

তাই নাকি?

মাটির সঙ্গে আরও জোরে চেপে ধরতে ধরতে সাড়া দেয় হারুন, হ্যাঁ।

ভাইয়েরা, হারুন ভাইকে ধরেন তো... একা না পেরে মিছিলের অন্যান্যদের অনুরোধ করলে, কয়েকজন এসে হারুনকে ধরলে সে আওলাদ মোল্লাকে ছেড়ে দেয়।

মিছিল পরিত্যক্ত আওলাদ মোল্লাকে এক প্রকার থেতলে দিয়েই চলে যায়। মুন্সি কফিলউদ্দিন সামনে গিয়ে সবাইকে দ্রুত পা চালাতে বলে। মুজিবনগরের আমাবাগান প্রায় পরিত্যাক্ত। চারদিকে ছোট ছোট গাছপালা, আগাছায় ভরে আছে। সেই গাছপালা আর আগাছার মধ্যে দাঁড়িয়ে যায় প্রায় শ’ পাঁচেক মানুষ। সবার সামনে মুন্সি কফিলউদ্দিন। তিনি ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে অনেকের সঙ্গে তিনিই এখানে মুজিবনগর সরকারকে স্যালুট দিয়েছিলেন। মুন্সির পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে অমল রিচার্ড মন্ডল, গোবিন্দ রায়।

মাথার  উপর আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। শ্রাবণের ঘন ভারী কালো মেঘে। বৃষ্টি হতে পারে যে কেনো সময়ে। নামাজের জানাজায় দাঁড়িয়ে মুন্সি কফিলউদ্দিন দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, আল্লাহু আকবার...।  সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফুড়ে নেমে আসে জলদ গম্ভীর বৃষ্টির ধারা। প্রত্যেকে ভিজতে ভিজতে জানাজা শেষ করে। নামাজ শেষ হওয়ার পরও চারদিক থেকে আরও মানুষ আসতে থাকে। কফিলউদ্দিন সবাইকে বলে, আবার শেখ মুজিবের নামে জানাজা হবে, আপনারা আসুন, আমার পিছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান।

দ্বিতীয়বার জানাজা পড়ার জন্য শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে যায়। একটু দূরে, প্রধান সড়কে মেহেরপুর থানা থেকে পুলিশের একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। হতবাক পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখে মুন্সি কফিলউদ্দিন কানের লতিতে দু’হাত স্পর্শ করে পুনরায় উচ্চারণ করছে, আল্লাহু আকবর...।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ