ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুন্ডাদের ‘ভূত’ তাড়ানিয়া ফাদার লুইজি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ২৭ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুন্ডাদের ‘ভূত’ তাড়ানিয়া ফাদার লুইজি

তাকে বলা যায় মুন্ডা সম্প্রদায়ের বাতিঘর। আবার মুন্ডাদের ‘ভূত’ তাড়ানিয়াও বলা যেতে পারে। তিনি ফাদার লুইজি পাজ্জি। বয়স যখন মাত্র ২৭ বছর তখন থেকে বাংলাদেশে। এখন বয়স ৭২ ছুঁয়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি সময় দেশের নিভৃত গ্রামে বাস করছেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে খানিক এগিয়ে দিতেই তার নিরলস চেষ্টা। পশ্চিম উপকূলের শ্যামনগরের নিভৃত গ্রাম ঈশ্বরীপুরে কথা হয় তার সঙ্গে। সেখানকার ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত যিশু আশ্রমের পরিচালক তিনি। এখানে পিছিয়ে পড়া মুন্ডা সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ শুরু করেন ২০০২ সালে। এর আগে ছিলেন খুলনার চুকনগরে, আরেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। মুন্ডাদের নিয়ে কী কাজ করছেন? পরিবর্তনই বা এলো কতটা? আরও কী করা যায়? প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ফাদার লুইজি পাজ্জির সঙ্গে কথা বলেছেন রফিকুল ইসলাম মন্টু 

রফিকুল ইসলাম মন্টু : মুন্ডা সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজের শুরুটা কীভাবে হলো?

ফাদার লুইজি : পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর খোঁজ পাওয়ার পর তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। জরিপ করি। প্রয়োজনটা বুঝি- এভাবেই কাজ শুরু হয়। প্রথমে আমরা দেখি ভয়ঙ্কর অবস্থা। কেউ লেখাপড়া জানে না। চার হাজারের মধ্যে মাত্র ৪০-৫০জন কোনমতে লেখাপড়া জানে- এও কী সম্ভব! কীভাবে ওরা স্বাভাবিকভাবে বসবাস করবে? সেজন্যে ওদের লেখাপড়ার ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রথম দিকে ওরা বিভিন্ন দাবি করতো সরকারের কাছে। যেমন শিক্ষা, ভাষাসহ নানান দাবি। কিন্তু ওদের সংখ্যা মাত্র ৪-৫ হাজার; তাই সরকারের দিক থেকে তেমন সাড়া মিলেনি। সংখ্যাটা ৪-৫ লাখ হলে হয়তো সরকার নজর দিত।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : ওরা যে আদিবাসী; সে শেকড় কীভাবে খুঁজে পেলেন?

ফাদার লুইজি : এদের ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু আমরা প্রথম দিকে পাইনি। এরপর বিভিন্নভাবে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করি। যেমন বাঙালিদের ইতিহাস। সেখানে ২-৩ লাইন আছে আদিবাসী মুন্ডা সম্পর্কে। সেখানে ওদের কথা বলা আছে। বলা হয়েছে- সুন্দরবনের আশপাশে একটা জাতি, নিগৃহীত শ্রেণীর মানুষের বসবাস আছে। যারা বনজঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদ করছে। এছাড়া সুন্দরবনের ইতিহাসেও সামান্য কিছু আছে। আরও কিছু ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে আমি নিজেই ওদের নিয়ে কিছুটা লিখেছি। তালার ইতিহাসে প্রথমে একটুখানি ছিল মুন্ডাদের কথা। পরের সংস্করণে আরও বেশি করে স্থান পায় এ সম্প্রদায়ের কথা। মুন্ডাদের ইতিহাস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের বয়সী ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। এদের অনেকে এখন বেঁচে নেই। আমরা এ সম্প্রদায়ের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করি। কেননা, এই তথ্য সংরক্ষণ বা ইতিহাস সংরক্ষণ না হলে এ জাতি মুছে যাবে।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : মুন্ডা সম্প্রদায় একসময় সম্পদশালী ছিল; ওদের জমি হাতছাড়া হলো কীভাবে?

ফাদার লুইজি: এক সময় এদের যথেষ্ট পরিমাণে জমি ছিল। আস্তে আস্তে বাঙালিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা এদের কাছ থেকে জমিগুলো নিয়ে নেয়। এরা তো বন জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদ করতো। জমিদারেরা এদের চাষাবাদের জন্য কিছু জমি দিয়ে দিত। কিন্তু কাগজপত্র দিত না। বলা হয়, তোমরা চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করো। আমি মনে করি, ওদের জমির যে কাগজপত্র নেই, এটাই প্রমাণ করে ওরা এই জমির মালিক। ওরা সহজ সরল জাতি। প্রভাবশালীরা ওদের ঠকিয়েছে। আমরা শুনেছি, আগেকার প্রভাবশালী হিন্দুরা এদের জমি আত্মসাৎ করেছে। জমির কাগজপত্র নেই বলেই সমস্যা হয়েছে। ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করতো। মুন্ডা সম্প্রদায়ের বয়সী ব্যক্তিরা বলেছেন, এরা বিভিন্ন সময় আর্থিক সমস্যার কারণে জমিদারদের শরণাপন্ন হতো। তখন জমিদারেরা এক বস্তা ধানের বিনিময়ে হয়তো এক একর জমি লিখে নিত। মুন্ডারা তা বুঝতো না। হিন্দুদের পর মুসলমানেরাও জমি নিয়েছে। দরকার এমন একটি সরকার, যারা ওদের জমির কাগজপত্র দিয়ে দিবে। কাগজপত্র ছাড়া তো ওরা জমির মালিক হবে না।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : কাজের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে নজর দিলেন?

ফাদার লুইজি : আমরা প্রথমে শিক্ষার ওপর জোর দেই। কেননা, আমরা মনে করেছি- শিক্ষার প্রসার না হলে অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। শিক্ষা একটি বড় কাজ। প্রথমে আমরা এদের মধ্যে যে শুমারী করেছিলাম, সেখানে দেখেছি মুন্ডা জনগোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে মেয়েদের চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। সাধারণত এমন হওয়ার কথা নয়। মেয়েদের সংখ্যাই বেশি থাকে। এ থেকে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। কারণ খুঁজতে গেলে এরা বলে আমাদের মেয়েরা বেশি মারা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওদের প্রথম সন্তান মারা যায়। যেটাকে এরা বলে ভূতে মারে। বিষয়টি দেখতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করি, বাল্য বিয়ের কারণে মেয়েদের প্রথম সন্তান; অনেক ক্ষেত্রে মা মারা যায়। ১২-১৩ বছর বয়সে এদের বিয়ে হয়ে যায়। এই বয়সে তো তারা মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : মুন্ডা সম্প্রদায়ের ‘ভূত’ তাড়াতে কী করলেন?

ফাদার লুইজি : প্রথম দিকে আমি এক অদ্ভুত কাজ করতে শুরু করলাম। তাতে তো এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য ঠিক হয়ে যায়। গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে অনেক মেয়েদের সঙ্গে দেখা হতো। তখন ওদের জিজ্ঞেস করতাম- কী বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে নাকি? বিয়ে হয়ে যাবে? বলতো- হ্যাঁ, সেরকম কথা হচ্ছে। বলতাম- তাইলে কী করবা? জবাবে ওরা বলতো- কী করবো? বিয়ে করতে হবে। তখন আমি বলতাম- এক কাজ করো, পালাও। বিদ্রোহ করো। বলে দাও- আমি রাজি না। বিয়ে করবো না। তখন ওরা বলতো- কোথায় পালাবো? আমি আমার ঘর দেখিয়ে বলতাম- আমার ওখানে এসো। থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। এরপর ২-৩ জন এখানে এলো পালিয়ে। সেই থেকে ওদের বিদ্রোহ শুরু। ৩-৪ বছরের মধ্যে আমার এখানে বিদ্রোহী মেয়ের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। একজনের দেখাদেখি আরেকজন আসে। এখানে ওরা থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি পায় লেখাপড়ার সুবিধা। এখন আর বিদ্রোহ করে মেয়েদের আসতে হয় না। অভিভাবকেরাই নিয়ে আসে।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : আপনাদের কাজের ফলে কী পরিবর্তন এসেছে?

ফাদার লুইজি : লেখাপড়ার দিক থেকে পরিবর্তন এসেছে। এখন মোটামুটি এ সম্প্রদায়ের সকল ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বাল্য বিয়ে কমেছে। টেকনিক্যাল শিক্ষা প্রসারের ফলে কাজের সুযোগ বেড়েছে। অনেকে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে আয় রোজগার বেড়েছে। এখানকার মেয়েরা মিলে একটি ক্রেডিট ইউনিয়ন চালাচ্ছে। এদের প্রায় ৫০ লাখ টাকা আছে। যিশু আশ্রম থেকে ব্যয়বহুল চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করা হয়।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের দূরত্ব কমেছে?

ফাদার লুইজি : মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকজন এককালে এলাকায় ‘জংলী’ বলে পরিচিত ছিল। এলাকার বাসিন্দারা গুরুত্ব দিত না। কেউ ঘেঁষত না এদের দিকে। ওদের যেন স্পর্শ করা যায় না। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে অনেকটা কমেছে বলে মনে হয়। যিশু আশ্রমে মেয়েদের দিকে অনেক ছেলের নজর পড়ে। অনেকে সম্পর্কও স্থাপন করতে চায়। এটাই এর একটা দৃষ্টান্ত। আগে কিন্তু এমন অবস্থা ছিল না।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : কাজ করতে গিয়ে আপনি কী কোনো ধরনের সমস্যায় পড়েছেন?

ফাদার লুইজি : গ্রামের বাড়িতে থাকলে এইসব মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে। এখানে রাখলে কোনমতে বাঁচানো যাবে। ঝুঁকি নিয়েই আমি এ উদ্যোগ নিলাম। প্রথমে যারা এলো তাদের নিয়ে কিছু গোলযোগ হলো ওদের সমাজের লোকজনের সাথে। কেননা, ওদের অভিভাবকেরা সবকিছু ঠিকঠাক করেছিল ওদের বিয়ে দিবে বলে। কিন্তু সেটা পারেনি। এ নিয়ে তাদের ক্ষোভ ছিল। আমি বলে দিলাম- আমি তো আপনাদের মেয়েকে ধরে বেঁধে রাখছি না। তারা না থাকলে চলে যাক। অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম। পরে এটা ঠিক হয়ে গেছে।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : অর্থের উৎস কোথায়, পরিচালিত হয় কীভাবে?

ফাদার লুইজি : খ্রীষ্টান ক্যাথলিক চার্চের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। চ্যারিটির মাধ্যমে অর্থ যোগাড় হয়। আর তা দিয়ে নিভৃতে সমাজ উন্নয়নে অংশ নেই আমরা। আমরা সাধারণত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করছি। আমরা খুঁজে খুঁজে বের করছি এদের। যেমন মুন্ডা সম্প্রদায়কে বের করলাম।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : মুন্ডা আদিবাসীদের প্রধান সমস্যা কী?

ফাদার লুইজি : প্রধান সমস্যা হচ্ছে জমি নেই। যেটুকু ঘরবাড়ি, ওটুকুই ওদের জমি। বাড়ির ভিটেও নেই অনেকের। অনেক স্থানে আবার উন্নয়ন কাজের জন্য এরা থাকতে পারছে না। কিছু এলাকায় বাঘের ভয় আছে। ক্ষুধার্ত বাঘ ছুটে আসে লোকালয়ে। এরপর আছে জলদস্যুর ভয়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জোয়ারের পানি বাড়ছে। দশ-পনেরো বছরের মধ্যে হয়তো পানির লেভেল রাস্তার উপরে উঠে যাবে। এসব সংকট রয়েছে। এজন্য কিছু পরিবার স্থানান্তর হতে চায়। তালা এলাকায় কয়েকটি পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদের ভূমি সমস্যা যতটা সম্ভব সমাধান করছি।

রফিকুল ইসলাম মন্টু : মুন্ডা সম্প্রদায়ের উন্নয়নে সরকার কী করতে পারে?

ফাদার লুইজি : সরকার তো অনেক কিছুই করতে পারে। একবার ঋণ দিয়েছিল। শূকর পালনের জন্য দিয়েছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সরকার তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওদের কর্মস্থান সৃষ্টি করতে পারে। ওদের নামে খাসজমি বরাদ্দ দিতে পারে। ফলে ওদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহীদের সহযোগিতা করতে পারে সরকার। এদের জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়া যেতে পারে। সুবিধা এদের কাছেও যায়; তবে সবার শেষে। এজন্য আবার ঘুষও দিতে হয়। ওদের পাড়ায় যাওয়ার জন্য যথাযথ রাস্তাঘাট হওয়া দরকার। বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এদের অবস্থার উন্নয়ন করতে পারে সরকার।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়