ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুশফিকের চোখে নিজের সেরা পাঁচ

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২৬ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
মুশফিকের চোখে নিজের সেরা পাঁচ

মাঠে নামার আগেই রেকর্ড। সেটাও লর্ডস ময়দানে। তখন মুশফিকুর রহিমের বয়স সতের ছুঁইছুঁই। বাংলাদেশের ৪১তম টেস্ট ক্যাপ নিয়ে পথ চলা শুরু। লর্ডসের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে (১৬ বছর ২৬৭ দিন) অভিষেকেই রেকর্ড।

২২ গজে ২০০৫ সালের ২৬ মে যাত্রা শুরু করেছিলেন মুশফিক। যখন যাত্রা শুরু করেছিলেন তখন আবীর মাখা মুখে কৈশরের ছাপ। ক্রিকেটের অলিগলি পেরিয়ে তিনি এখন হাইওয়েতে। বেড়েছে বয়স, বেড়েছে অভিজ্ঞতা। নিজের ব্যাটকে করেছেন শাণিত। আজ ২০২০ সালের ২৬ মে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের ১৫ বছর পূর্ণ হলও বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের।

প্রাপ্তির খাতা ভরপুর। সবুজ গালিচায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রজাপতির মতোই তাঁর সাফল্যভান্ডার।যতই পরিণত হয়েছেন, ততই নির্ভার হয়েছেন এবং নির্ভার করেছেন দলকে।তাইতো নামের পাশে এখন যুক্ত হয়েছে মিস্টার ডিপেন্ডেবল। অনেক প্রাপ্তির মধ্যে নিজের পছন্দ তো থাকেই। ১৫ বছর পূর্তির দিনে তাঁর নিজের পছন্দের সেরা পাঁচ মুহূর্ত জানালেন মুশফিক।

টেস্ট অভিষেক, লর্ডস ২০০৫ 

‘টেস্ট দলে আচমকা ডাক পেয়েছিলাম। আমি তখনও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে। সেখানেই শুনেছি। আমি দ্রুত চলে এসে বড়দের দলে যোগ দেই। আমার কাছে পুরো বিষয়টি ছিল স্বপ্নের মতো। যাদের খেলা টিভিতে দেখেছি, যাদের ট্রেনিং দূর থেকে অনুসরণ করেছি এখন তাদের সাথেই সফর করবো। পাইলট ভাই (খালেদ মাসুদ) অনুশীলন ম্যাচগুলোতে বিশ্রামে থাকায় আমি সুযোগ পাই। সাসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৬৩ ও ১১৫ রানের দুই ইনিংস খেলে সব আলো নিজের উপর কেড়ে নেই। ইংল্যান্ড সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা ছিল। কারণ এর আগের বছরই আমরা রিচার্ড ম্যাকিন্সের আন্ডারে সফর করেছিলাম। তবুও কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। যেহেতু আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল। স্টিভ হার্মিসন, ম্যাথু হোগার্ড ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফকে সামলানো তখন সহজ ছিল না। তবে কোচের কথায় আমি সাহস পেয়েছিলাম। সিনিয়ররা আমাকে উৎসাহিত করেছিল। আমার বাবা সব সময় আমাকে বলতেন, বগুড়ার আলতাফুন্নেসা হোক আর লর্ডসের ময়দান ২২ গজ সব সময়ই এক। আমি আমার অভিষেক উপভোগ করেছি। আমি কোনও বড় রান করিনি (১৯ ও ৩) । কিন্তু আমি দীর্ঘ সময় উইকেটে টিকে ছিলাম। ওই ধরনের অ্যাটাকের বিপক্ষে প্রথম অবস্থায় খেলা কঠিন ছিল কিন্তু আমার মনোবল আমাকে শক্তি দিয়েছিল। সাথে সাথে বুঝেও গিয়েছিলাম পরবর্তী পর্যায়ে খেলার জন্য আমাকে কতটা প্রস্তুত হতে হবে।’ 

২০০৭ বিশ্বকাপ, প্রতিপক্ষ ভারত

‘আমার উপর প্রচণ্ড চাপ ছিল প্রথম ম্যাচের আগে। বিশেষ করে পাইলট ভাইয়ের জায়গায় নেওয়া ছিল চ্যালেঞ্জের। উনি বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন সার্ভিস দিয়েছেন। মনে হচ্ছিল কেউ ইনজুরিতে পড়লে আমার সুযোগ হবে। কিন্তু আমি প্রথম পছন্দ জেনে খুব ভালো লেগেছিল। আমার প্রথম বিশ্বকাপ, স্বাভাবিকভাবেই আমার উত্তেজনা ছিল আকাশছোঁয়া। বিশ্বকাপের আগে ডিনার পার্টিতে ব্রায়ান লারা ও শচীন টেন্ডুলকারকে দেখে আমার রোমাঞ্চ আরও বেড়ে গেয়েছিল। ভারতের বিপক্ষে আমাদের প্রথম ম্যাচ পোর্ট অব স্পেনে। ওদেরকে অল্প রানে আটকে বোলাররা নিজেদের কাজ করে রেখেছিল। বিরতির সময় আমি জানলাম, তিন ব্যাটিং করবো। আমি সময় পেয়েছিলাম নিজেকে নিয়ে ভাবার। তামিম শুরুতে আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল। এরপর আমি ব্যাটিংয়ে যাই। শুরু থেকেই কিছুটা রক্ষণাত্মক ছিলাম।কিন্তু সময় যাওয়ার পর আমিও নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারি। সাকিবের সঙ্গে আমার দারুণ জুটি হয়েছিল। অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে আমি আর ও একসঙ্গে খেলেছি। এজন্য আমাদের রসায়ন ভালো ছিল। জয়ের রান এসেছিল আমার ব্যাট থেকে। আশরাফুল ভাই আমাকে সেই সুযোগটি দিয়েছিল। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। আগের ওভারেই জহির খানকে মারতে পারতেন। কিন্তু আমি বলায় ডট করেছিল। ম্যাচের পর দারুণ মজা করেছিলাম। দেশ থেকে দারুণ সব শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছি যেগুলো আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।’ 

অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচ, মিরপুর ২০১১

‘অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচে ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ জেতানো অবশ্যই আমার জন্য দারুণ স্মৃতি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমার খুব বেশি বড় ইনিংস নেই। তবে স্মরণীয় ইনিংস অবশ্যই আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ম্যাচটিই অন্যতম।ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল। পরের বছরই ওরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ম্যাচটায় নাটকীয় মুহূর্ত চলে এসেছিল শেষ পর্যায়ে। আমাদের শেষ তিন ওভারে ২৭ রান লাগত। আমার বিশ্বাস ছিল শেষ ওভার পর্যন্ত টিকে থাকলে আমাদের সুযোগ থাকবে। রবি রামপল শেষ ওভার করত এসেছিল। আমার সাথে রাজ ভাই (আব্দুর রাজ্জাক) ছিল। শেষ দুই বলে আমাদের ৪ রানের মতো লাগত। আমি রাজ ভাইকে আগেই বলেছিলাম আমরা পঞ্চম বলে দুই রান নেব। যদি উনি আউট হয়েও যায় তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু পঞ্চম বল আমি গ্যালারিতে পাঠাই। রবি রামপল ইয়র্কার মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি একটু সরে আসায় লেন্থ বল পেয়ে যায়। আমার জন্য ছিল পারফেক্ট জোন। তাতেই বল যায় ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচ জেতানো সেটাও মাঠে থেকে, এটা অবশ্যই আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তির।’

প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, গল ২০১৩ 

‘আমি এখনও বিশ্বাস করি ওইটা আমার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। আশরাফুল ভাই দুর্ভাগ্যবশত ১৯০ রানে আউট হয়ে গিয়েছিল। নয়তো উনি দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি পেতেন। সেই সুযোগটি আমি নষ্ট করিনি। আল্লাহর রহমতে আমি মাইলস্টোনে পৌঁছে যাই। আমি মনে করি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও ওই ইনিংসটি অনেক বড়। কারণ আমাদের সামনে তখন বড় কোনও ইনিংস ছিল না। এখন যেমন চিন্তা করি যে দুইশ হয়েছে তিনশ করবো। তামিম যেমন ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছে (ঘরোয়া ক্রিকেটে)। এখন বুঝি যে সেটাও করা সম্ভব। সেজন্য ওই ডাবল সেঞ্চুরিটা খুবই স্পেশাল। গলে সেবার কঠিন পরিস্থিতি ছিল না। আমরা ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেট পেয়েছি। সচরাচর গল এরকম থাকে না। ওরাও সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল। ১৩৫ ওভারের মতো কিপিং করে ব্যাটিং করা কঠিন ছিল। কিন্তু আমি পেরেছিলাম। আমার এখনও মনে আছে আগের রাতের ডিনারে আশরাফুল ভাইকে বলেছিলাম আপনি ডাবল সেঞ্চুরি করেন এরপর আমি করবো। এরপর ২৫০, ৩০০ হয়ে যাবে। কোনও ছাড়াছাড়ি নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উনি মিস করে ফেলে। আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস সেটাকেই বলবো।’

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫৯, ওয়েলিংটন ২০১৭

‘এটা আমার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা ইনিংস। হ্যামস্ট্রিং চোটে বাইরে থাকার পর আমি ফিরে আসি টেস্ট ম্যাচ। ওয়েলিংটনের কন্ডিশন বরাবরই কঠিন। ভালোমানের উইকেট, সাথে দুর্দান্ত পেস অ্যাটাক। সব মিলিয়ে আমাদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি। তামিম ও মুমিনুল ভালো খেলায় আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম আমি পারব। সাকিবও তাই। সাকিব তো সেই ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরিও করল। আমার আর ওর বিশাল জুটি হলও, প্রায় ৩৫৯ রানের মতো। সেদিন কোয়ালিটি পেস অ্যাটাকের বিপক্ষে নিজের ব্যাটিং দারুণ উপভোগ করছিলাম। বিশেষ করে নীল ওয়াগনারের বোলিং। এতো ধারাবাহিক শর্ট বল করে যাচ্ছিল। সাথে সুইং তো ছিলই। আমার জন্য কাজটা কঠিন ছিল। কিন্তু সেদিন আমি নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ে জিতেছিলাম। হয়তো ইনিংস আরও বড় করা যেত। আরও লম্বাও হতো। তবুও যেটা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।’


ঢাকা/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়