ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘ম্যাচ না খেললে মনের ভয় দূর হবে না’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ম্যাচ না খেললে মনের ভয় দূর হবে না’

টেস্টে উন্নতির জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর কথা বলেছেন স্থানীয় কোচ মিজানুর রহমান বাবুল। গতানুগতিক পরিকল্পনা থেকে সরে এসে ঘরোয়া ক্রিকেট ঢেলে সাজানোর পরামর্শ তার।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কয়েকটি ভেন্যু নিয়ে রয়েছে তার আপত্তি। বৃষ্টির দাপটে যেসব ভেন্যুর ম্যাচ ভেস্তে যায়, সেগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। মিজানুর রহমানের হাত ধরেই গড়ে ওঠা এ কালের মেহেদী হাসান মিরাজ, নাজমুল হোসেন শান্ত, আফিফ হোসেন ধ্রুব ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের মতো তরুণ ক্রিকেটার। যুব ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম সফল কোচ তিনি। এখনো কাজ করছেন বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়ে অভিজ্ঞ এ কোচের সঙ্গে কথা বলেছে রাইজিংবিডি

বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের টেস্ট তো অবশ্যই দেখেছেন। দুই দলের পার্থক্য কোথায় দেখলেন?

মিজানুর রহমান: আসলে মাঠে হেরে গেলে অনেক কিছু নিয়ে কথা হবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেক ফাঁকফোকর বের হবে। ম্যাচটি যদি আবার আমাদের পক্ষে চলে আসত, তখন ওগুলো নিয়ে আর আলোচনা হতো না। ব্যাটিংটা যদি একটু ভালো হতো, তাহলে আমার মনে হয় না রেজাল্ট আমাদের বিপক্ষে যেত। ওদের বোলারদের বিপক্ষে আমাদের ব্যাটসম্যানরা লড়াই করতে পারেনি, এটাই আমার চোখে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে। এর বাইরে তেমন কিছু নয়। আমাদের নিজেদের মাটিতে আরো ভালো করার সামর্থ্য ছিল। আমরা সামর্থ্য দিয়ে খেলতে পারিনি। ওরা ওই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।

পরিকল্পনার ঘাটতি চোখে পড়েছে?

মিজানুর রহমান: পরিকল্পনা ঠিকঠাক মতোই ছিল। আসলে যে তিনজনের ওপর বাংলাদেশ দল একটু বেশি নির্ভর ছিল, তাদের পারফরম্যান্সে ঠিকঠাক মতো হয়নি। সাকিবের কথা বলি, বিশ্বকাপে ওর থেকে ভালো আর কেউ করতে পেরেছিল? একা বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়েছে তিনটা। ওই পারফরম্যান্সটা এখানে করতে পারেনি। মাহমুদউল্লাহ টাচে ছিল না। মুশফিকের ব্যাটে রান ছিল না। ধারাবাহিকতার অভাব ছিল। তামিম ছিল না দলে। তাই বাকিদের পারফরম্যান্সটা আসলে কাউন্ট না হওয়ায় ফল আসেনি। পরিকল্পনা হয়তো ঠিকই ছিল। কিন্তু হয়নি এই আর কী…

শেষ দিন কিন্তু চাইলেই ম্যাচটা বাঁচানো যেত। আপনি তো ছেলেদের অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের তেঁড়েফুড়ে মারার আগ্রাহ, টেস্ট ব্যাটিংয়ে আগ্রাসন দেখানোব্যাটিং মানসিকতা কতটা হতাশ করেছে আপনাকে?

মিজানুর রহমান: আপনি টেস্টে কেন আগ্রাসন দেখাবেন, সেটা আগে বলেন। এটা তো হতাশার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, টেস্ট ব্যাটিংয়ের মানসিকতা অনুশীলন করে হয় না। সাকিব  নিজেও স্বীকার করেছে সে মানসিকভাবে পিছিয়ে ছিল। ও নিতে পারছিল না বলে ও ব্যাট চালিয়ে দিয়েছে। এই উন্নতিগুলো কখন হবে? আপনি যখন সত্যিকারের পরিস্থিতিতে এর আগে পড়বেন, তখন আপনি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারবেন। সত্যিকারের পরিস্থিতি বলতে আপনাকে ম্যাচ খেলতে হবে। জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ আমাদের আছে। জাতীয় দলের খেলা না থাকলে এ দুটো খেলতেই হবে। পাশাপাশি বাইরের দেশের সঙ্গে আমাদের ‘এ’ দলের, এইচপি দলের আরো চার দিনের ম্যাচ আয়োজন করতে হবে। ওখানে যদি আপনি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন, তাহলে আপনি টেস্ট ক্রিকেটে সেই একই মঞ্চ পাবেন। আপনি যতই অনুশীলন করেন, যতই আপনি নেটে ব্যাটিং করেন বা বোলিং করেন, আপনি যদি ম্যাচ না খেলেন তাহলে মনের ভয় আপনার থেকে দূরে যাবে না।

কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে তো অধিনায়কের অনেক আপত্তি আছে...

মিজানুর রহমান: সেটা থাকতে পারে। এজন্য কাউকে নির্দিষ্ট করে দায়ী করা ঠিক হবে না। সবাই চেষ্টা করছে নিজের সাধ্যমতো।

এজন্য বিসিবির দায় আছে নাকি খেলোয়াড়দের দায়-টাই বেশি?

মিজানুর রহমান: বিসিবি তো চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার মতে নিজেদের উন্নতির জন্য খেলোয়াড়দের এক ধাপ এগিয়ে আসতে হবে।

আর বিসিবি?

মিজানুর রহমান: বিসিবি তার গতানুগতিক পরিকল্পনায় এনসিএল শুরু করতে যাচ্ছে। ভেন্যুগুলো নিয়ে বিসিবি কাজ করতে পারে। যেমন বগুড়ার কথা বলতে পারি। বৃষ্টি হলে ওখানে খেলা শেষ। একটা দিনও ওখানে বল মাঠে গড়ায় না। আবার কক্সবাজারের কথা ধরুন। সমুদ্রের পাশে বলে ওখানে বৃষ্টির একটা শঙ্কা থাকে সব সময়। টানা বৃষ্টি পড়লে ম্যাচ শেষ। কয়টা ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় একজন খেলোয়াড়? আমি একবার সিলেটে কাজ করেছি। এখনো মনে আছে সিজনের অর্ধেক ম্যাচ আমি খেলতে পারিনি।  একটা দলের অর্ধেক খেলা যদি না হয়, তাহলে খেলোয়াড়দের পারফর্ম করার সুযোগ থাকে কোথায়। আমার পরামর্শ, এমন ভেন্যুগুলো নির্বাচন করা যেখানে বৃষ্টির শঙ্কা একটু কম থাকে। বৃষ্টির ওপর তো হাত থাকবে না। আবার বৃষ্টি হলে যেন খেলার সুযোগটা অন্তত থাকে। বগুড়ার মাঠ তো আপনি চাইলেই শুকাতে পারবেন না। ধরুন এক সেশন বৃষ্টি হলো। পরের দুই সেশন তো খেলা হবে। এরকম ভেন্যু লাগবে। ওখানে খেলতে হবে। তাহলে ছেলেরা খেলার সুযোগ হবে। ওসব ভেন্যু বাদ দিয়ে এসব ভেন্যু নির্বাচন করতে হবে।

এছাড়া আর কোনো পরামর্শ?

মিজানুর রহমান: বিসিএল এমন সময় হয় যে, উইকেট একদম ফ্ল্যাট থাকে। এটা আমার পর্যবেক্ষণ। যেখানে উইকেট ফ্ল্যাট থাকে, ওখানে অনেক রান হচ্ছে দেখবেন। কেউ কেউ দুইশ মেরে দিচ্ছে।  বোলারদের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। আমার পরামর্শ, আমরা আন্তর্জাতিক যে কোনো দলকে স্বাগত জানাই স্পিন ট্র্যাক দিয়ে, তাহলে কেন বিসিএলে আমরা স্পিন ট্র্যাক বানাই না? ওখানে খেলে দেশের সেরা ৬০ খেলোয়াড়। ওদের থেকেই তো দল নির্বাচন করা হয়। ওরা যদি বিসিএলেই স্পিন ট্র্যাকে খেলে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তীতে মানিয়ে নিতে কষ্ট করতে হয় না। আবার কিছু জায়গায় আপনি পেস উইকেট বানিয়ে দেন, যেখানে ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিতে পারবেন। পেসাররা কিছু সুবিধা পাবে। এমন সময় এর আগে খেলা হয়েছে যে ঘাস রাখা সম্ভব হয় না। এসব জিনিসগুলো বিসিবির উন্নতি করা উচিত।

টেস্ট স্কোয়াড আলাদা করার বিলাসিতা কি আমরা দেখাতে পারি?

মিজানুর রহমান: এটা অবশ্যই করা যায়। যেই খেলোয়াড়ের মধ্যে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে ভালোর করার সামর্থ্য রয়েছে তাকে আপনি চাইলেই আলাদা করতে পারেন। সাদমানকে আমরা এখন সেভাবে গোনায় ধরছি। আপনি সাইফকে এখানে রাখতে পারেন অবশ্যই। বিসিএল, এনসিএল খেলছে ভালো। নাজমুল হোসেন শান্তকে দেখতে পারেন, ও সীমিত পরিসরে বেঙ্গালুরুতে ভালো খেলেছে। কিছু কিছু নির্বাচিত খেলোয়াড় দীর্ঘ পরিসরের জন্য আছে বিশ্বের সব জায়গায়। আমরাও এখন সেটা চিন্তা করতে পারি।  দেখেন আপনি মুমিনুলকে টেস্টের জন্য পুরোপুরি তৈরি করে ফেলেছেন। এরকম আরো কয়েকটা খেলোয়াড়কে বেছে নিয়ে তাদের সেভাবে তৈরি করান। ওরাও তাহলে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নেবে যে, না আমি টেস্ট দলের একজন। ছেলেদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে, সাথে সাথে বিসিবির আলাদা খেলোয়াড় তৈরি করতে হবে।

আফিফ সম্প্রতি জাতীয় দলে খেলেছেন। তাকে কি তিন ফরম্যাটের জন্য বিবেচনা করা ঠিক হবে?

মিজানুর রহমান: আমি আসলে ওকে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির জন্য বেশি বিবেচনা করব। ওখানে ও অনেক এগিয়ে। ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। টেস্টে আসলে ভালো করতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ওর ওই ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমি সীমিত পরিসরে ওকে এগিয়ে রাখব। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের সেরা বাছাই সে।

আমাদের নতুন কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে কেমন লাগছে? সম্প্রতি তিনি ‘এ’ দলের খেলা দেখতে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছেন

মিজানুর রহমান: এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। শুনেছি ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে খোঁজখবর রাখেন। ওখানে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা আছে। তাদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাবেন। বিশ্বকাপের পর কোচিং স্টাফ বদলানো হয়েছে। তাদের মাথায় কিছু না কিছু ঘুরছে। হয়তো সামনেই আমরা তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে পারব। বিসিবি যে কোচিং স্টাফ যুক্ত করেছে তাদের নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে ভালো কিছু পাব, সেই আশা করাই যায়।

বাংলাদেশ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে প্রবেশ করছে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে। কেমন প্রত্যাশা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে?

মিজানুর রহমান: এখন বর্তমান পারফরম্যান্স দিয়ে যদি চিন্তা করি, তাহলে আমাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এর আগের কথা যদি চিন্তা করি, ওদের মাটিতে কিন্তু আমরা খারাপ করিনি। কোচ তো আছেন। হয়তো এই সময়ের মধ্যে গুছিয়ে নিতে পারবেন যে আমরা লড়াই করার অবস্থানে চলে যেতে পারব।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরিকল্পনা কি এখনই শুরু করা উচিত?  

মিজানুর রহমান: এখন থেকে চিন্তা করা উচিত কাদেরকে আমি বিশ্বকাপে নেব। ওই ছেলেদেরকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা উচিত। আমাদের ওয়ানডে স্কোয়াড ঠিকঠাক আছে। টি-টোয়েন্টিতে শক্তির প্রয়োজন হয়। পেশি শক্তির প্রয়োজন হয়। ওরকম কিছু নির্বাচিত খেলোয়াড়কে যদি আমরা এখন থেকে বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করি তাহলে আমাদরে সামনে ভালো সুযোগ থাকবে। আমার মনে হয় না খারাপ কিছু হবে।


ঢাকা/ইয়াসিন/পরাগ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়