ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যে তিন কারণে সৌদির তেল সাম্রাজ্যে আঘাত

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৮ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
যে তিন কারণে সৌদির তেল সাম্রাজ্যে আঘাত

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি আজ ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। আশঙ্কা করা হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও একটা মহামন্দার ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, এই মন্দা ১৯২০ সালের মহামন্দার চেয়েও ভয়াবহ হবে। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর সরকারের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। মন্দার আশঙ্কায় ঘুম উবে গেছে সরকার প্রধানদের।

এই আশঙ্কা ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে। বিশেষ করে অর্থনীতির এই নিম্নগতির ধাক্কা বেশি লেগেছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী ও তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে। কারণ বিশ্বব্যাপী লকডাউন পরিস্থিতিতে সৌদি অর্থনীতির চালিকা শক্তি তেলের ব্যবহার কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে ব্যাপক হারে তেলের দামও কমেছে। দামের এমন ভয়াবহ পতনের ফলে সৌদির রপ্তানী আয়ের সিংহভাগ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সৌদি আরবের মোট জিডিপির অর্ধেক ও রপ্তানী আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাস খাত থেকে।

তবে লকডাউন ছাড়াও সৌদির তেল সাম্রাজ্যে আঘাতের আরও কিছু কারণ খুঁজে বের করেছেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ‘মিডল ইস্ট আই’-এর সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট। কারণগুলো নিয়ে তিনি বিশদ নিবন্ধ লিখেছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর সাবেক এই সাংবাদিক মোটা দাগে এর ৩টি কারণ খুঁজে পেয়েছেন।

তিনি প্রিন্স সালমানের অদূরদর্শীতাকে এক নম্বর কারণ হিসেবে বলছেন। দৃশ্যত বাদশা সালমান সৌদি আরবের বাদশা হলেও প্রশাসনিক কলকাঠি নাড়েন তার পুত্র ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান। তিনিই বর্তমানে সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাধার মানুষ। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর তাকে বিশ্ববাসী যতটা দূরদর্শী ও দক্ষ ভেবেছিল দিনে দিনে সেই ধারণা ফিঁকে হতে শুরু করেছে। তিনি দুরদর্শী তো নন-ই, তার নেওয়া একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে সৌদি অর্থনীতি রুগ্ন হয়ে পড়েছে।

ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অপশাসন, যুদ্ধ ও মানুষ হত্যার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে পড়েছে। তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, সমরাস্ত্র কেনার প্রবণতা, ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত সৌদি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। আর সৌদি অর্থনীতি এতটাই তেল নির্ভরশীল যে, এই প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়েছে তেল খাতের ওপর। অস্থিতিশীল হয়েছে তেলের বাজার।

দেশের আধুনিকায়নে প্রিন্স সালমান যে উচ্চবিলাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে বিদেশী বিনিয়োগ আনার যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, তেলের দাম ৫০-৫৫ ডলারে নেমে গেলে ২০২৪ সাল নাগাদ সৌদির রিজার্ভ ৫ মাসের আমদানী ব্যয় মেটানোর সমান হয়ে যাবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফলে তেল সাম্রাজ্যে যে সৌদির প্রভাব তা ভবিষ্যতে কমে যাবে এটা প্রায় সুনিশ্চিত। 

দ্বিতীয় কারণ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা। সৌদি শাসকেরা বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রপন্থী। ফলে ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের অম্ল-মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে গত মাসে ওপেক সম্মেলনের সময় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান এই সম্পর্ককে তিক্ততায় নামিয়ে আনেন। প্রিন্স সালমান প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করে তেলের বাজার নিয়ে চড়া কথা শুনিয়েছেন।  এতে ক্ষিপ্ত হন পুতিন। এরপর থেকে বিশ্বের দুই শীর্ষ তেল রপ্তানীকারক দেশ তেলের দাম কমানোর এক অশুভ প্রতিযোগীতা শুরু করে।

ফলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমতে থাকে। এতে রাশিয়ার অর্থনীতিতে খুব বেশি ধাক্কা না লাগলেও বড়সড় ধাক্কা লেগেছে সৌদি অর্থনীতিতে। কারণ রাশিয়ার আয়ের উৎসে এক ধরনের ভারসাম্য থাকলেও, সৌদি অর্থনীতি অনেকাংশে তেল নির্ভর।

হজ ও ওমরাহ বাতিল তেল বিপর্যয়ের আরেকটি কারণ। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সৌদি আরবের অর্থনীতি নিম্নগামী। প্রবৃদ্ধ ছিল মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ। এই নিম্নগামী প্রবৃদ্ধিতে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে হজ ও ওমরাহ বাতিলকরণ। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় প্রতিবছর সৌদি আরবে প্রায় ১ কোটি মানুষ হজ করতে যান। এই বিশালসংখ্যক মানুষ প্রতি বছর দেশটির অর্থনীতিতে ৮০০ কোটি ডলার সম-পরিমাণ অর্থ যোগ করে। কিন্তু এ বছর এই বিশাল অঙ্কের অর্থ আয় হচ্ছে না। ফলে টান পড়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কমছে কোষাগারের অর্থ। বাদশা সালমান দায়িত্ব নেওয়ার সময় যে কোষাগারে অর্থ ছিল ৭৩,২০০ কোটি ডলার। বর্তমানে এই অর্থের পরিমাণ কমে ৪৯ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ কমে যাওয়ার কারণে সৌদি সরকারকে রপ্তানী আয় বাড়াতে কম মূল্যে তেল বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে তেল উৎপাদন বাড়লেও মূল্য কমে আয়ের পরিমাণ কমে গেছে।

সৌদি আরবের এই তেল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে হয়তো আঞ্চলিক প্রতিযোগী দেশগুলো খুশি হবে। তবে ডেভিড হার্স্ট সতর্ক করে দিয়েছেন সৌদির পতনে এই অঞ্চলে কারোরই খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ সৌদি আরব এই অঞ্চলের অর্থনীতির প্রধান ইঞ্জিন। সেখানে কিছু হলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিশর, সুদান, জর্ডান, লেবানন, তিউনেশিয়ার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবী বেকার হয়ে পড়বে। তাই এই অঞ্চলের সকল দেশকে আগত এই পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়