যেভাবে অপরিহার্য শেখ হাসিনা
৩৮ বছর আগে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে যখন তাকে দলটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, তখন ভাঙনের মুখে আওয়ামী লীগ। সেই স্থান থেকে আজকে আওয়ামী লীগকে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পুরো কৃতিত্ব তার দক্ষ নেতৃত্বের, বিচক্ষণ দূরদর্শিতার। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ক্রমেই দুর্বল হতে থাকা আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবন দিয়েছেন তিনিই।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ এ সম্পর্কে এক লেখায় বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ মোটামুটি ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। দলের মধ্যে ছন্দটা হারিয়ে গিয়েছিল। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আলাদা আওয়ামী লীগ-এমন পরিস্থিতিতে দল আবার ভাঙার অবস্থা হয়েছিল।
‘দলকে এক রাখার জন্যেই দলের কয়েকজন নেতা দিল্লিতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার সাথে পরামর্শ করতে এবং তারা তাকে রাজি করান সভাপতির পদ নিতে।”
শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়া যখন ভারতে অবস্থান করছিলেন, তখন ১৯৭৯ ও ১৯৮০-এই দুই বছরে কয়েকজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজ-খবর নিতে।
প্রয়াত এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক কাবুল যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সাথে দেখা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, তৎকালীন যুবলীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দিল্লিতে যান। তাদের সে সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো।’
১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সে সময় বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কেবল শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা। পরবর্তীতে তিনি আশ্রয় পান ভারতে। প্রবাসে ছয় বছর অতিবাহিত করার পর ১৯৮২ সালের ১৭মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। সেই দিন আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে ছিল বিশেষ কিছু। যেন বঙ্গবন্ধুকে আবার ফিরে পাওয়া!
সেই যে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন, সেই থেকে ক্লান্তিহীনভাবে বেয়ে চলেছেন নৌকা। আর নৌকার যাত্রীরা তাকিয়ে থাকেন তার দিকে; কখন কোন দিকে হবে তাদের যাত্রা। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে কর্মীদের কাছে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন কখনো জননেত্রী, কখনো মানবতার নেত্রী, কখনো খুব পরিচিত প্রিয় সেই ‘আপা’।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তখন শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
গত ৩৮ বছর ধরে টানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ হাসিনা। এবার নিয়ে রেকর্ড নবমবার দলের সভাপতির দায়িত্ব পেলেন। এই সময়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন চারবার। দলকে নিয়ে গেছেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। নিজে অবসর চাইলেও তাই নেতাকর্মীরা তার বিকল্প দেখতে চান না। শেখ হাসিনাই তাদের কাছে সর্বশেষ আশ্রয়স্থল।
২১তম সম্মেলনে তাই দায়িত্ব পেয়ে কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগে আছি, এখানেই থাকব। এটাই আমার পরিবার। ‘৭৫ সালে আমি মা-বাবা, ভাই-বোন হারিয়ে বিশাল এক পরিবার পেয়েছি। সেটা হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিবার। নেতাকর্মীদের ভালোবাসাই আমার চলার পথের শক্তি। আমার অর্থ-সম্পদ নেই। নেতাকর্মীদের ভালোবাসাই আমার একমাত্র শক্তি।’
১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে চতুর্দশ সম্মেলনে, ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর পঞ্চদশ সম্মেলনে, ১৯৯৭ সালের মে মাসে ষোড়শ সম্মেলনে, ২০০২ সালের ডিসেম্বরে সপ্তদশ সম্মেলনে, ২০০৯ সালের জুলাইয়ে অষ্টাদশ সম্মেলনে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর ঊনিবিংশ সম্মেলনে এবং ২০১৬ সালে বিংশতম সম্মেলনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন হাসিনা। ২০১৯ সালে ২১তম জাতীয় সম্মেলনেও সভাপতির দায়িত্ব পেলেন তিনি।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়।
প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে এখন পর্যন্ত ২০টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে আওয়ামী লীগের। এসব সসেম্মলনে এখন পর্যন্ত সভাপতি হয়েছেন সাতজন। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ আটবার, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দুইবার এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও আবদুল মালেক উকিল একবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন একবার।
ঢাকা/পারভেজ/সনি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন