ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রজনীগন্ধাপুর : অষ্টম পর্ব

ইমদাদুল হক মিলন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১১, ১৬ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রজনীগন্ধাপুর : অষ্টম পর্ব

|| ইমদাদুল হক মিলন ||

গ্রামের এই ধরনের লোকজন হাঁস মুরগি পালে। পাঁচ দশটা হাঁস মুরগি থাকে প্রত্যেক গৃহস্থবাড়িতেই। এই বাড়িতেও আছে। হাসেমের আছে, কদমের আছে। এক খোঁয়াড়ে মুরগি, এক খোঁয়াড়ে হাঁস। এক রাতে মুরগির খোঁয়াড়ে ঝাপটা ঝাপটি শুরু করেছে মুরগিগুলো। গরম কাল। কদমের বউ বুঝতে পারেনি ঘটনা কী...

খোঁয়াড়ে সাপ ঢুকেছিল?

হ্যাঁ।

বুঝেছি। তারপর, তারপর?

মিলিয়ার আচরণে ছেলেমানুষি। একেবারে কিশোরি মেয়ের মতো জামির বাহু চেপে ধরে, অতি ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে জামির গায়ে চেপে গল্প শুনতে চাইছে।

মিলিয়ার এই আচরণ জামি খুবই পছন্দ করে। মুখ ঘুরিয়ে মুগ্ধ চোখে মিলিয়ার দিকে তাকালো। আলতো করে তার ঠোঁটে একবার ঠোঁট ছুঁইয়েই ফিরিয়ে নিল।

এই এখন এমন করো না।

তাহলে কখন করবো?

ওসব পরে। এখন গল্প বলো।

গল্প না, ঘটনা।

ঠিক আছে বাবা, বলো।


মহিলা হারিকেন হাতে বেরিয়েছে। রাত বোধহয় দশটা এগারোটা হবে। গ্রাম এলাকায় রাত দশটা মানে গভীর রাত। সন্ধ্যাবেলাই খেয়েদেয়ে সবাই শুয়ে পড়ে। কদম আর তার বাচ্চা কাচ্চারা, হাসেমের পরিবার সবাই ঘুমে। বেরিয়েছে শুধু কদমের বউ। খোঁয়াড়ে মুরগিগুলো ঝাপটা ঝাপটি করছেই। সে গিয়ে খোঁয়াড় খুলেছে। সঙ্গে সঙ্গে হিসসস করে শব্দ এবং ছোবল। মহিলার ডানহাতে। মহিলার আর্তচিৎকারে সবাই উঠেছে। হাসেম কদম বুদ্ধি করে সাপে ছোবল দিলে প্রাথমিক ভাবে যে কাজটা করতে হয়, ছোবলের জায়গা থেকে ওপর দিকে পর পর তিনটা বাঁধ দিতে হয়, সেই বাঁধটা দিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করতে পারেনি। বাজারের দিকে এক লোক রেন্ট-এ-কার চালায়। মাইক্রোবাস আছে একটা। ওই মাইক্রোবাসে ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এই করে কদমের বউ বাঁচল।


তুমি এত কিছু জানলে কী করে? এত ডিটেইল বললে?

এখানে আমি প্রায়ই আসি। শওকত ভাইয়ের গ্রামটা আমিই তৈরি করে দিচ্ছি। আমাকে আসতেই হয়। আসা মানে হচ্ছে এই লোকগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করা। আমি মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসি। মিশতে পছন্দ করি। আর পারিও। চট করেই মিশতে পারি মানুষের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে তাদের মতো করে কথা বলা, তাদের জীবনের গল্প শোনা, সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার কথা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করা। আমার ভাল লাগে।

মিলিয়ার হাত ছাড়িয়ে দিল জামি। সেই হাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল তাকে।

তোমার জন্য একটা সুসংবাদ আছে।

জামির গলার কাছে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো মিলিয়া। কী বলো তো?

এখন ফাগুন মাসের মাত্র শুরু। শীত পুরোপুরি যায়নি। গরম পড়তে শুরু করেনি।

বসন্তকাল।

হ্যাঁ বসন্তকাল। শীতনিদ্রা শেষ করে সাপেরা এখনও বেরোতে শুরু করেনি। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। সাপ দেখতে পাবে না। দংশনের চান্স তেমন নেই।

আরেকটা সাপ যে দংশন করছে।

মানে?

এই যে তুমি!

দংশন করছি না, প্যাচ দিয়ে ধরেছি তোমাকে।

মিলিয়া কিশোরি প্রেমিকার মতো দুহাতে জামির কোমরের কাছটা জড়িয়ে ধরল।

জামি বলল, তোমার অবস্থাটা কিন্তু সাপিনীর মতো।

আমি আজ সাপিনীই হতে চাই।

হও, যা হতে চাও হও।

ওরা দুজন ওরকম জড়াজড়ি করেই হাঁটতে লাগল।


মিলিয়া বলল, শওকত ভাই একটা কাজ করলেই পারতেন।

কী কাজ?

যেহেতু কদমের বউকে সাপে কেটেছিল, এই ব্যাপারে তাঁর সচেতন হওয়া উচিত ছিল।

তাঁর সচেতন হওয়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে বলো। রজনীগন্ধাপুর আমার প্রজেক্ট। আমার আইডিয়াতেই হচ্ছে সব।

তা জানি।

তাহলে?

না মানে আমি বলতে চাইছি, তোমাকেই বলছি, তোমার উচিত ছিল বাড়ির আশপাশে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে দেওয়া। তাহলে সাপ পালাতো।

তা আমরা চাই না।

মানে?

মূল আইডিয়া তোমাকে বুঝতে হবে। শওকত ভাই একটা গ্রাম তৈরি করছেন। বাংলাদেশের ফেলে আসা গ্রাম। যে কারণে ইলেকট্রিসিটি পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। হারিকেন কুপি দিয়ে কাজ চলছে। টিভি চলছে ব্যাটারিতে। আমরা চাইছি গ্রামে যে ধরনের জীবজন্তু সরীসৃপ থাকে তার সবই এখানে থাকুক।

বুঝলাম। কিন্তু  ওই ফেলে আসা গ্রাম পাবে না।

তা পাবো না। মানে পুরোপুরি পাবো না। ইলেকট্রিসিটি না হয় না নিলাম, টিভি মোবাইল তো এভয়েড করা যাবে না। এখনকার ডিজিটাল সময় কোনও না কোনওভাবে ঢুকবেই এই গ্রামে। তার পরও যতটা পারা যায়।

কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ মরে যাবে তা না, দূরে পালিয়ে যাবে। সেই ব্যবস্থাটা করলে আমাদের মতো লোকজনের বেড়াতে সুবিধা হয়। প্রেম করতে সুবিধা হয়। সাপের ভয়ে আরষ্ট হয়ে থাকলে কি আর প্রেম হবে! লাভমেকিং শুরু করলাম আমরা তখনই কাছে কোথাও শোনা গেল সাপের হিস হিস। বা দেখা গেল পায়ের কাছে ফণা তুলে আছে সাপ।

তেমন হওয়ার চান্স নেই। তুমি ভয় পেও না।

ঠিক আছে, পাবো না ভয়।

ঠিক আছে সাপের ভয় পুরোপুরিই ভাঙিয়ে দিচ্ছি। কদমের বউকে সাপে কাটার পর আমি এখানে কার্বলিক অ্যাসিড ব্যবহার করছি। কারণ ওরা থাকতে চাচ্ছিল না।

তাই বলো।

আজ আমরা এখানে আসবো, সঙ্গে বাচ্চারা থাকবে সেজন্য গত দুদিন ধরে হাসেম কদম নতুন করে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়েছে। সাপের ভয় নেই। শীতনিদ্রা শেষ করে যদি কোনও সাপ বেরিয়ে থাকে, সেগুলো পালিয়েছে।

যাক বাবা। এখন একদম নিশ্চিন্ত।

জামি গাঢ় চোখে মিলিয়ার দিকে তাকালো। আমি ভেবেছিলাম তুমি আজ শাড়ি পরবে।

তোমার প্রিয় আকাশি রংয়ের শাড়ি?

না, আকাশি না হলেও চলতো। যে রকম টিয়া পাখি রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরেছো এই রংয়ের পরলেও চলতো।

আমি আজ প্রকৃতির রং, গাছপালার রং ধারণ করার চেষ্টা করেছি। প্রকৃতির অংশ হতে চাইছি। এজন্য এই রংয়ের সালোয়ার কামিজ। বেড়াবার জন্য সালোয়ার কামিজই ভাল।

তা জানি। কিন্তু লিনা ভাবি পরেননি। তিনি বেগুনি শাড়ি পরেছেন।

বউ মানুষ, এজন্যই হয়তো পরেছেন।


চারদিকে এখন সকাল শেষ হওয়া রোদ। ঘন গাছপালার ফাঁক ফোকড় দিয়ে সাদা কাগজের টুকরোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে তলায়। হাওয়ায় তোলপাড় করছে গাছের ডালপালা, পাখি ডাকছে, ঝিঁঝি ডাকছে ঝোঁপঝাড়ে। বুনোফুলের গন্ধ আছে। অসাধারণ এক পরিবেশ।

ওরা ধীর পায়ে হাঁটছে। হাওয়া আর ফুলের গন্ধে মুগ্ধ হচ্ছে।

মিলিয়া বলল, লিনা ভাবির কথা বলো। শওকত ভাইয়ের প্রথমজনের কথা সবই জানলাম। এখন দ্বিতীয় জনের কথা বলো।

জামি বলল, লিনা ভাবি খুব সুন্দরী না?

চোখ পড়েছে নাকি?

ধুৎ কী বলো!

আমার সামনে কাউকে সুন্দরী বললে আমার খুব লাগে।

তোমার সঙ্গে অন্য কাউকে তুলনা করছো কেন? তুমি তুমিই।

আমি যে খুব ঈর্ষাকাতর, তুমি কি তা জানো?

কিছুটা জানি।

শুধু তোমার ব্যাপারে।

তাও জানি।

এই যে রুবানা এখন দেশে নেই, আমি কিন্তু খুব ভাল ঘুমাই।

মানে?

মানে আবার কী? রাতে আমার ঘুমটা ভাল হয়।

কেন?

রুবানা থাকলে মনে হয় তুমি তার সঙ্গে শুয়ে আছো।

সেটাই স্বাভাবিক না?

স্বাভাবিক তো বটেই কিন্তু ঈর্ষায় আমি ঘুমাতে পারি না। আমার শুধু মনে হয় তুমি তার সঙ্গে এই করছো, ওই করছো!

ওসব এখন তার সঙ্গে খুবই কম হয় এখন।

ফালতু কথা বলো না।

ফালতু কথা না। সত্য কথা বলছি।

কেন? কার চাহিদা কমেছে? তোমার না তার?

তোমাকে পাওয়ার পর থেকে তার সঙ্গ আমার ভাল লাগে না। বোধহয় তারও লাগে না। সে একদম ইন্টারেস্ট দেখায় না।

সিনেমার মতো দুজন দুদিকে মুখ করে শুয়ে থাকো?

বললে কি তুমি বিশ্বাস করবে?

করবো।

সত্যি?

সত্যি।

আগেও কিন্তু তোমাকে বলেছি, তুমি বিশ্বাস করোনি।

তোমরা দুজন দুই বিছানায় থাকো, এই তো?

হ্যাঁ।

তাহলে সে ছেলের কাছে যাওয়ার সময় এই কথা বলল কেন?

আমাকে স্বাধীন করে দেওয়ার কথা?

হ্যাঁ।

এসব প্রায়ই বলে।


আরও নিবিড় করে জামিকে জড়িয়ে ধরল মিলিয়া। যা ইচ্ছে বলুক গিয়ে। আমরা যেভাবে চলছি এভাবেই চলবো।

একটু থেমে বলল, তোমার ছেলেও নিশ্চয় জানে আমাদের রিলেশানসিপের ব্যাপারটা ...

অবশ্যই জানে।

তোমাকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেছে?

না। সে এক অদ্ভুত ছেলে। তুমি যদি তার সঙ্গে কথা বলো বা আমাদের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করো ও জীবনেও সে কথা আমাকে বা ওর মাকে বলবে না।

এ কথা তুমি আমাকে আগেও বলেছো।

আমার ছেলে তার নামের মতোই। আদর্শ।

অসাধারণ নাম রেখেছো ছেলের। আদর্শ। এ রকম নাম কেউ রাখে না।

আমি চাই সে তার নামের মতো হোক।

আর বাবা এদিক দিয়ে বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করে বেড়াক!

কী করবো, বলো। এক সময় মনে মনে তোমাকে চেয়েছি। না পেয়ে রুবানার দিকে চলে গেলাম। অনেক পরে নিয়তি ঠিকই আমার আশা পূরণ করলো। তখন দুজনের জীবনই বদলে গেছে। আমি পুত্রের জনক হয়ে গেছি, তুমিও দুজনের মা। তার পরও কেমন কেমন করে সব হয়ে গেল।

আচ্ছা আমাদের এই সম্পর্কটা কতোটা মানসিক বলো তো? নাকি শুধুই শারীরিক?

কী বলছো? শুধু শারীরিক হবে কেন? মন ছাড়া শরীর অর্থহীন। এই ধরনের সম্পর্ককে বলে মনোদৈহিক সম্পর্ক।

ইস কী যে সব শব্দ বের করে লোকে! মনোদৈহিক। এইসব ফালতু শব্দ। আসল শব্দটা প্রেম। প্রেম, শুধুই প্রেম। প্রেম না থাকলে এমন হয় না। ভালবাসা না থাকলে এমন হয় না। বলো, লিনা ভাবীর কথা বলো।

তোমার কি ক্লান্ত লাগছে?

না, কেন?

এভাবেই হাঁটতে থাকবে না কোথাও বসবে?

চলো বসি। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়